বলধা গার্ডেন
যান্ত্রিক নগরীতে একটুকরো সবুজ ছায়া
মেহেদী হাসান
মেহেদী হাসান
১৯১৩ সালে নোবেল বিজয়ের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল বলধা গার্ডেনে। বলধার ক্যামেলিয়ার রূপে মুগ্ধ হয়েই রবীন্দ্র অমর্ত সেনকেও সংবর্ধনা দেয়া হয় এখানে। রবীন্দনাথের মতো বলধার রূপে মুগ্ধ হন অমর্ত সেনও। তিনি অবশ্য প্রেমে পড়েন এখানকার ক্যাকটাস গ্যালারির। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তি আসেন এই গার্ডেনে। তাঁরাও বিমোহিত হয়েছেন এর অপার সৌন্দর্যে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখানে বেড়াতে এসে অনেকেই অসচেতনভাবে নষ্ট করছে অনেক দুর্লভ গাছ। ফলে বাগানের সৌন্দর্যহানি হচ্ছে। বর্তমানে বাগানের সর্বত্র দেখা যায় অযত্নের ছোঁয়া। দর্শনার্থীদের ফেলে-দেয়া চিপসের প্যাকেট, চকোলেটের খোসা, সিগারেটের ফিল্টার বাগানের যেখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে আর ভাসছে শঙ্খনদ পুকুরের পানিতে, যা এর সৌন্দর্য ও পরিবেশকে মস্নান করছে। একই সঙ্গে অনেক দুর্লভ গাছও হারিয়ে যাচ্ছে বাগান থেকে। এ ছাড়া চারপাশ ঘিরে উঁচু দালানকোঠা ওঠায় বাগানের গাছপালা সূর্যের আলোর অভাবে বিপন্নের পথে। উঁচু ভবন আর পাকা রাস্তার কারণে নিচু হয়ে গেছে বাগানের মাটির স্তর। কারখানার বর্জ্য, দর্শনার্থীদের ফেলে-যাওয়া পলিথিন, বর্জ্য ছাড়াও সিবিলি অংশে অত্যধিক লোকসমাগম ও শঙ্খনদ পুকুরে প্লাস্টিক বর্জ্য, প্লাস্টিক ক্যান প্রভৃতি পরিবেশপরিপন্থী দূষণে জর্জরিত হয়ে পড়েছে ঐতিহাসিক এ বলধা গার্ডেন।
বলধা গার্ডেনে 'সাইকি' ও 'সিবিলি' নামে দুটি অংশ রয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ বৃক্ষ, বিরুৎ আর গুল্ম নিয়ে সাজানো হয়েছে সাইকি ও সিবিলি অংশ। সাইকি আর সিবিলি শব্দ দুটি গ্রিক ভাষা থেকে নেয়া। সিবিলি অর্থ 'প্রকৃতি', যেখানে সবুজের রূপ আর মহিমা থাকে। সাইকি মানে 'আত্মা'। সব মিলিয়ে দাঁড়ায় 'প্রকৃতির আত্মা'। বলধা গার্ডেন যেন রাজধানী ঢাকার বুকে প্রকৃতির আত্মারই প্রতিচ্ছবি। জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৪৩ সালের ১৩ আগস্ট তাঁর মুতু্যর আগেই পূর্ণতা পায় বলধা গার্ডেন।
১৯০৯ সালে ৩৬ শতাংশ অর্থাৎ ৩.৩৮ একর জমির ওপর সাইকি অংশের কাজ শুরু হয়। ১৯৩৬ সালের মধ্যে এটি সম্পন্ন হয়। ১৯৩৮ সালে শুরু হয় বাগানের উত্তর অংশ সিবিলির কাজ। ১৯৪৩ সালে সেটিও শেষ হয়। আবার বাগানের কলেবর বৃদ্ধির জন্য ঢাকার বিখ্যাত ব্যবসায়ী লাল মোহনের কথাও জানা যায়, যিনি 'শঙ্খনিধি' নামে পরিচিত ছিলেন। জমিদারের কাছ থেকে 'শঙ্খনাদ' পুকুর ও সূর্যঘড়িসহ একটি অংশটি কিনে নেন। ওই অংশের খেজুর ও কাঠবাদামগাছটি এখনো বেঁচে আছে।
বলধার গার্ডেনে রয়েছে প্রায় ২৫,০০০ উদ্ভিদ। এতে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৬৭২টি। বিভিন্ন অর্কিড, ক্যাকটাস, জলজ উদ্ভিদসহ বলধা গার্ডেনে যে গাছপালা আছে, তা শুধু এ দেশের জন্যই বিরল সম্পদ নয়, বরং বিশ্বের সব উদ্ভিদ বিশারদ ও গবেষকদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর প্রায় অর্ধশতাধিক দেশের মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য বৃক্ষের সন্ধান মেলে এখানে।
আগে এখানে যে গোলাপের বাগান ছিল তাতে প্রায় ২০০ প্রজাতির গোলাপ ছিল, যার অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত। তবে পরিচর্যাকারীদের বরাত দিয়ে জানা যায় বর্তমানে এখানে আরো গাছ লাগানো হচ্ছে। বর্তমানে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে নতুন প্রজাতির কিছু উদ্ভিদ সংযোজন করা হয়েছে। বার্ডস অব প্যারাডাইস (অর্কিড জাতীয়), এলাচিফুল, সেঞ্চুরি প্ল্যান্ট, কদম, চালতা, আফ্রিকান টিউলিপ, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, ভূর্জপত্র ইত্যাদি গাছ তো আছেই এমনকি প্রাচীনকালে লেখার কাজে ব্যবহূত হতো এমন গাছও এখানে রয়েছে। আরো আছে আকর্ষণীয় আমাজান লিলি। বলধা গার্ডেনের অভ্যন্তরের পুকুরটি সাধারণত জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাজান লিলির বাহারে প্রস্ফুটিত থাকে। বছরের বাকি ছয় মাস আমাজান লিলি না থাকলেও পুকুরের বাঁধানো ঘাঁটে বসে পাখিদের কল-কাকলিতে মন উদাস হয়ে যাবে যে কারো। একসময়কার আকর্ষণ সূর্যঘড়িটি বর্তমানে নষ্ট, তবে তা সংরক্ষিত আছে। বাগানের পূর্বদিকেই রয়েছে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর সমাধি, প্রকৃতির নিপুণ শিল্পকে প্রত্যক্ষ করতে যিনি গড়ে তুলেছিলেন বলধা গার্ডেন।
বলধা গার্ডেনের সাইকি অংশটি সংরক্ষিত। পুরনো মুচকুন্দচাঁপা, ডেউয়া, নাগলিঙ্গম, কনকচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, তেঁতুল ইত্যাদি গাছে ঝুলে থাকতে দেখা যায় অসংখ্য বাদুড়। আগত দর্শনার্থীদের জন্য এরা বাড়তি উপভোগের বিষয় হয়ে উঠেছে। বলধার সাইকি অংশে ৭০ বছর বয়সি শারদ মলি্লকা গাছটিতে এখনো সুগন্ধি সাদা পাপড়ির ফুল ফঁটতে দেখা যায়। জাপান থেকে আনা হয়েছিল ক্যামেলিয়াকে। তার বাহারি রূপ বলধাকে দিয়েছে বাড়তি আকর্ষণ। বিভিন্ন রঙের ক্যামেলিয়া ফুটতে দেখা যায় বাগানে। সাদা, গোলাপি ও লাল রঙের ফুল সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফুটে থাকে। লতাজবা, ক্যানাংগা, কনকসুধা, কণ্টকলতা, পেপিরাস, কর্ডিয়া, পারুল, পোর্টল্যান্ডিয়া, ওলিয়া তো আছেই। লতাজবারা আবার বেয়ে ওঠে অন্য গাছে, শিমগাছের মতো দোল খায় বাতাসে। চিরসবুজ দৃষ্টিনন্দন স্রাব-জাতীয় উদ্ভিদ অঞ্জন। নীল রঙের ছোট ফুল ফোটে অঞ্জনে। প্রায় ৬০ বছর বয়সি দুটি গাছ রয়েছে সিবলি অংশে। আমাদের দেশে লাল ফুলের অশোকগাছ দেখা যায়। তবে বলধায় স্থান করে আছে রাজ অশোক। কমলা রঙের ফুলে রাজ অশোকের গাছ ছেয়ে যায়। আবার স্বর্ণ অশোকও সোনালি ফুলে ভরে ওঠে। এ ছাড়া জাকুনিয়া, ধুপ, আক্রোকারপাস, রুপেলিজা, হিং, বার্মা শিমুল, ব্রুনসফেলিয়া, নাগলিঙ্গম ইত্যাদি গাছও রয়েছে এখানে। বাগানের অর্কিড হাউসে প্রায় ২০০ জাতের অর্কিড সংরক্ষণ করা আছে। বলধা গার্ডেনকে বৃক্ষ, জলাশয়, অর্কিড হাউস ও অন্যান্য উদ্ভিদ কর্ণার মিলে এক অপূর্ব উদ্যান বলা চলে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর কর্মের সহযোগিতায় ছিলেন আরেক প্রকৃতি প্রেমিক অমৃত আচার্য। বলধা গ্রামের জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী এসেছিলেন ঢাকার ওয়ারীতে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি কালচারাল হাউস। ধীরে ধীরে এটি ঘিরেই গড়ে ওঠে একটি উদ্যান। বলধার জমিদার উদ্যানটা গড়েছিলেন বলেই ওটা বলধা গার্ডেন নামে পরিচিতি পায়। ঢাকা মহানগরীতে বলধা গার্ডেন ছাড়া তেমন কোনো সার্থক উদ্যান এর আগে দেখা যায়নি। ১৯০৯ সালে এটি গার্ডেন হিসেবে তৈরি হয়। বহু প্রজাতির উদ্ভিদের সমাহার গার্ডেনটির প্রধান বৈশিষ্ট্য।
গাজীপুরের বলধা এস্টেটের মূল জমিদার ছিলেন খগেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। তার কোনো সন্তান-সন্ততি ছিল না। তাই তাঁর সম্পত্তি বন্ধুর ছেলে নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীকে দিয়ে যান। জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ১৮৮০ সালে গাছার জমিদার মহিন চন্দ্রের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন ১৪ বছর, তখন নিঃসন্তান বলধার জমিদার তাঁকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে নরেন্দ্র নারায়ণই হন বলধার জমিদার।
বলধা গ্রাম এখন গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল বারিয়া ইউনিয়নের দড়ি বলধা মৌজায়। বলাধার জমিদার গ্রামের বাইরে দার্জিলিং, কলকাতা, লক্ষ্মৌ, পুরী ও ঢাকার ওয়ারীতে বাড়ি তৈরি করেন। তিনি ঢাকার ওয়ারীর বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন কালচারাল হাউস; পরে সেটি পরিচিতি পায় বলধা হাউস নামে। কালচারাল হাউসের সাথে বলধা লাইব্রেরিও গড়ে তোলা হয়েছিল।
১৯২৫ সালে নারায়ণ চৌধুরী বলধা গার্ডেনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলধা জাদুঘর। সেটি ছিল তার পারিবারিক জাদুঘর। নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ছিলেন সংগীতরশিক, প্রকৃতি প্রেমিক ও দুর্লভ বস্তুর সংগ্রাহক। তিনি যেখানেই যেতেন, সেখান থেকেই কোনো-না-কোনো দুর্লভ বস্তু সংগ্রহ করতেন। তাই তাঁর ওই জাদুঘরটি ছিল মুদ্রা, ভাস্কর্যসহ প্রায় ৪০০০ নির্দশনের সংরক্ষণাগার। বর্তমানে তাঁর সেসব সংগ্রহ ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া ১৯৪০ সালে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর একমাত্র ছেলে নৃপেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী আততায়ীর হাতে নিহত হলে জমিদার গভীরভাবে শোকাহত হন। ছেলে হারানোর শোকে ১৯৪৩ সালের ১৩ আগস্ট তিনিও পরলোকগত হন। বাবা ও ছেলের স্মৃতিস্তম্ভ বলধা গার্ডেনের সিবলি অংশে সংগৃহীত রয়েছে।
১৯৪৩ সালে নরেন্দ্র নারায়ণের মৃতু্যর পরপর মস্নান হতে থাকে বলধার অপরূপ সৌন্দর্য। তবে ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পরও বাগানের অবয়ব প্রায় অবিকৃতই ছিল। বাগানটি সংরক্ষণ করার জন্য ১৯৫১ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ডস এবং ১৯৬২ সালে বনবিভাগের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়।
এই যান্ত্রিক ঢাকা নগরীতে একটুকরো সবুজ ছায়াঘন প্রশান্ত পরিবেশ জাগিয়ে রাখতে বলধা গার্ডেনকে বাঁচিয়ে রাখা অতীব প্রয়োজন। মাটি ভরাট, সুষ্ঠু বর্জ্যব্যবস্থাপনা, নতুন অবকাঠামো তৈরি, নতুন নতুন চারা রোপণ, সযত্ন রক্ষণা-বেক্ষণ আর গণসচেতনতাই এ ঐতিহাসিক নিদর্শনটিকে স্বমহিমায় বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
বলধা গার্ডেনে 'সাইকি' ও 'সিবিলি' নামে দুটি অংশ রয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ বৃক্ষ, বিরুৎ আর গুল্ম নিয়ে সাজানো হয়েছে সাইকি ও সিবিলি অংশ। সাইকি আর সিবিলি শব্দ দুটি গ্রিক ভাষা থেকে নেয়া। সিবিলি অর্থ 'প্রকৃতি', যেখানে সবুজের রূপ আর মহিমা থাকে। সাইকি মানে 'আত্মা'। সব মিলিয়ে দাঁড়ায় 'প্রকৃতির আত্মা'। বলধা গার্ডেন যেন রাজধানী ঢাকার বুকে প্রকৃতির আত্মারই প্রতিচ্ছবি। জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৪৩ সালের ১৩ আগস্ট তাঁর মুতু্যর আগেই পূর্ণতা পায় বলধা গার্ডেন।
১৯০৯ সালে ৩৬ শতাংশ অর্থাৎ ৩.৩৮ একর জমির ওপর সাইকি অংশের কাজ শুরু হয়। ১৯৩৬ সালের মধ্যে এটি সম্পন্ন হয়। ১৯৩৮ সালে শুরু হয় বাগানের উত্তর অংশ সিবিলির কাজ। ১৯৪৩ সালে সেটিও শেষ হয়। আবার বাগানের কলেবর বৃদ্ধির জন্য ঢাকার বিখ্যাত ব্যবসায়ী লাল মোহনের কথাও জানা যায়, যিনি 'শঙ্খনিধি' নামে পরিচিত ছিলেন। জমিদারের কাছ থেকে 'শঙ্খনাদ' পুকুর ও সূর্যঘড়িসহ একটি অংশটি কিনে নেন। ওই অংশের খেজুর ও কাঠবাদামগাছটি এখনো বেঁচে আছে।
বলধার গার্ডেনে রয়েছে প্রায় ২৫,০০০ উদ্ভিদ। এতে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৬৭২টি। বিভিন্ন অর্কিড, ক্যাকটাস, জলজ উদ্ভিদসহ বলধা গার্ডেনে যে গাছপালা আছে, তা শুধু এ দেশের জন্যই বিরল সম্পদ নয়, বরং বিশ্বের সব উদ্ভিদ বিশারদ ও গবেষকদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর প্রায় অর্ধশতাধিক দেশের মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য বৃক্ষের সন্ধান মেলে এখানে।
আগে এখানে যে গোলাপের বাগান ছিল তাতে প্রায় ২০০ প্রজাতির গোলাপ ছিল, যার অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত। তবে পরিচর্যাকারীদের বরাত দিয়ে জানা যায় বর্তমানে এখানে আরো গাছ লাগানো হচ্ছে। বর্তমানে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে নতুন প্রজাতির কিছু উদ্ভিদ সংযোজন করা হয়েছে। বার্ডস অব প্যারাডাইস (অর্কিড জাতীয়), এলাচিফুল, সেঞ্চুরি প্ল্যান্ট, কদম, চালতা, আফ্রিকান টিউলিপ, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, ভূর্জপত্র ইত্যাদি গাছ তো আছেই এমনকি প্রাচীনকালে লেখার কাজে ব্যবহূত হতো এমন গাছও এখানে রয়েছে। আরো আছে আকর্ষণীয় আমাজান লিলি। বলধা গার্ডেনের অভ্যন্তরের পুকুরটি সাধারণত জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাজান লিলির বাহারে প্রস্ফুটিত থাকে। বছরের বাকি ছয় মাস আমাজান লিলি না থাকলেও পুকুরের বাঁধানো ঘাঁটে বসে পাখিদের কল-কাকলিতে মন উদাস হয়ে যাবে যে কারো। একসময়কার আকর্ষণ সূর্যঘড়িটি বর্তমানে নষ্ট, তবে তা সংরক্ষিত আছে। বাগানের পূর্বদিকেই রয়েছে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর সমাধি, প্রকৃতির নিপুণ শিল্পকে প্রত্যক্ষ করতে যিনি গড়ে তুলেছিলেন বলধা গার্ডেন।
বলধা গার্ডেনের সাইকি অংশটি সংরক্ষিত। পুরনো মুচকুন্দচাঁপা, ডেউয়া, নাগলিঙ্গম, কনকচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, তেঁতুল ইত্যাদি গাছে ঝুলে থাকতে দেখা যায় অসংখ্য বাদুড়। আগত দর্শনার্থীদের জন্য এরা বাড়তি উপভোগের বিষয় হয়ে উঠেছে। বলধার সাইকি অংশে ৭০ বছর বয়সি শারদ মলি্লকা গাছটিতে এখনো সুগন্ধি সাদা পাপড়ির ফুল ফঁটতে দেখা যায়। জাপান থেকে আনা হয়েছিল ক্যামেলিয়াকে। তার বাহারি রূপ বলধাকে দিয়েছে বাড়তি আকর্ষণ। বিভিন্ন রঙের ক্যামেলিয়া ফুটতে দেখা যায় বাগানে। সাদা, গোলাপি ও লাল রঙের ফুল সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফুটে থাকে। লতাজবা, ক্যানাংগা, কনকসুধা, কণ্টকলতা, পেপিরাস, কর্ডিয়া, পারুল, পোর্টল্যান্ডিয়া, ওলিয়া তো আছেই। লতাজবারা আবার বেয়ে ওঠে অন্য গাছে, শিমগাছের মতো দোল খায় বাতাসে। চিরসবুজ দৃষ্টিনন্দন স্রাব-জাতীয় উদ্ভিদ অঞ্জন। নীল রঙের ছোট ফুল ফোটে অঞ্জনে। প্রায় ৬০ বছর বয়সি দুটি গাছ রয়েছে সিবলি অংশে। আমাদের দেশে লাল ফুলের অশোকগাছ দেখা যায়। তবে বলধায় স্থান করে আছে রাজ অশোক। কমলা রঙের ফুলে রাজ অশোকের গাছ ছেয়ে যায়। আবার স্বর্ণ অশোকও সোনালি ফুলে ভরে ওঠে। এ ছাড়া জাকুনিয়া, ধুপ, আক্রোকারপাস, রুপেলিজা, হিং, বার্মা শিমুল, ব্রুনসফেলিয়া, নাগলিঙ্গম ইত্যাদি গাছও রয়েছে এখানে। বাগানের অর্কিড হাউসে প্রায় ২০০ জাতের অর্কিড সংরক্ষণ করা আছে। বলধা গার্ডেনকে বৃক্ষ, জলাশয়, অর্কিড হাউস ও অন্যান্য উদ্ভিদ কর্ণার মিলে এক অপূর্ব উদ্যান বলা চলে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর কর্মের সহযোগিতায় ছিলেন আরেক প্রকৃতি প্রেমিক অমৃত আচার্য। বলধা গ্রামের জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী এসেছিলেন ঢাকার ওয়ারীতে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি কালচারাল হাউস। ধীরে ধীরে এটি ঘিরেই গড়ে ওঠে একটি উদ্যান। বলধার জমিদার উদ্যানটা গড়েছিলেন বলেই ওটা বলধা গার্ডেন নামে পরিচিতি পায়। ঢাকা মহানগরীতে বলধা গার্ডেন ছাড়া তেমন কোনো সার্থক উদ্যান এর আগে দেখা যায়নি। ১৯০৯ সালে এটি গার্ডেন হিসেবে তৈরি হয়। বহু প্রজাতির উদ্ভিদের সমাহার গার্ডেনটির প্রধান বৈশিষ্ট্য।
গাজীপুরের বলধা এস্টেটের মূল জমিদার ছিলেন খগেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। তার কোনো সন্তান-সন্ততি ছিল না। তাই তাঁর সম্পত্তি বন্ধুর ছেলে নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীকে দিয়ে যান। জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ১৮৮০ সালে গাছার জমিদার মহিন চন্দ্রের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন ১৪ বছর, তখন নিঃসন্তান বলধার জমিদার তাঁকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে নরেন্দ্র নারায়ণই হন বলধার জমিদার।
বলধা গ্রাম এখন গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল বারিয়া ইউনিয়নের দড়ি বলধা মৌজায়। বলাধার জমিদার গ্রামের বাইরে দার্জিলিং, কলকাতা, লক্ষ্মৌ, পুরী ও ঢাকার ওয়ারীতে বাড়ি তৈরি করেন। তিনি ঢাকার ওয়ারীর বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন কালচারাল হাউস; পরে সেটি পরিচিতি পায় বলধা হাউস নামে। কালচারাল হাউসের সাথে বলধা লাইব্রেরিও গড়ে তোলা হয়েছিল।
১৯২৫ সালে নারায়ণ চৌধুরী বলধা গার্ডেনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলধা জাদুঘর। সেটি ছিল তার পারিবারিক জাদুঘর। নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ছিলেন সংগীতরশিক, প্রকৃতি প্রেমিক ও দুর্লভ বস্তুর সংগ্রাহক। তিনি যেখানেই যেতেন, সেখান থেকেই কোনো-না-কোনো দুর্লভ বস্তু সংগ্রহ করতেন। তাই তাঁর ওই জাদুঘরটি ছিল মুদ্রা, ভাস্কর্যসহ প্রায় ৪০০০ নির্দশনের সংরক্ষণাগার। বর্তমানে তাঁর সেসব সংগ্রহ ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া ১৯৪০ সালে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর একমাত্র ছেলে নৃপেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী আততায়ীর হাতে নিহত হলে জমিদার গভীরভাবে শোকাহত হন। ছেলে হারানোর শোকে ১৯৪৩ সালের ১৩ আগস্ট তিনিও পরলোকগত হন। বাবা ও ছেলের স্মৃতিস্তম্ভ বলধা গার্ডেনের সিবলি অংশে সংগৃহীত রয়েছে।
১৯৪৩ সালে নরেন্দ্র নারায়ণের মৃতু্যর পরপর মস্নান হতে থাকে বলধার অপরূপ সৌন্দর্য। তবে ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পরও বাগানের অবয়ব প্রায় অবিকৃতই ছিল। বাগানটি সংরক্ষণ করার জন্য ১৯৫১ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ডস এবং ১৯৬২ সালে বনবিভাগের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়।
এই যান্ত্রিক ঢাকা নগরীতে একটুকরো সবুজ ছায়াঘন প্রশান্ত পরিবেশ জাগিয়ে রাখতে বলধা গার্ডেনকে বাঁচিয়ে রাখা অতীব প্রয়োজন। মাটি ভরাট, সুষ্ঠু বর্জ্যব্যবস্থাপনা, নতুন অবকাঠামো তৈরি, নতুন নতুন চারা রোপণ, সযত্ন রক্ষণা-বেক্ষণ আর গণসচেতনতাই এ ঐতিহাসিক নিদর্শনটিকে স্বমহিমায় বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
No comments:
Post a Comment