Pages

Search This Blog

Monday, December 6, 2010

নগর ঐতিহ্যঢাকার আদি অধিবাসীর রসবোধবর্ষায় বাড়ির ছাদ চুইয়ে পানি পড়লে ভাড়াটিয়া তা মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সেই ঢাকাইয়া বাড়ির মালিক উত্তর দিতেন, 'মাসে তিন টাকা ভাড়ার বাড়ির ছাদ দিয়া পানি পড়ব না তো কি শরবত পড়ব!' এমন বহু রঙ্গ-রসিকতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানা অলিগলিতে। স্বপন কুমার দাস
রহস্যময় নগরী ঢাকা। ৪০০ বছরের প্রাচীন এ রাজধানী নগরীকে কেন্দ্র করে যুগে যুগে বহু জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে। সময়ান্তে আবার তাদের বিলুপ্তিও ঘটেছে। কিন্তু তাদের নানা কাজকর্মের জন্য আজও তারা আলোচিত। ঢাকার আদি অধিবাসীও তেমনি একটি গুণের কারণে দেশব্যাপী আলোচিত। আর সে গুণটি হচ্ছে তাঁদের রসবোধ।
যাঁরা বহু বছর ধরে বংশপরম্পরায় পুরান ঢাকায় বসবাস করে আসছেন তাঁদের ঢাকার আদি অধিবাসী বলা হয়। তাঁদের আচার-ব্যবহার ও ভাষারীতিও আর দশটা সাধারণ নাগরিকের চেয়ে আলাদা। তবে তাঁরা অধিকাংশেরই ধর্ম ইসলাম। তাঁরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। একটা শ্রেণী ছিল তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত। অপর শ্রেণীটি শিক্ষায় অনগ্রসর। নানা সংস্কারে আবদ্ধ। তাঁদের বলা হতো কুট্টি। তাঁরা উর্দু ও হিন্দির মিশ্রণে কথা বলতেন। আবার বাংলা ভাষায় ছিল বেশ পটু। রঙ্গরস মিশিয়ে কথা বলা ছিল তাঁদের সহজাত অভ্যাস। এ গুণের কারণেই তাঁরা সব মহলে আলোচিত।
একসময় ঢাকার আদি অধিবাসীর জীবন ছিল বৈচিত্র্যহীন আর একঘেয়েমিতে ভরা। ধর্মীয় ও বৈবাহিক অনুষ্ঠানাদি ছাড়া তাঁদের জীবনে তেমন কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল না। তাঁরা কেউ ছিল সাধারণ দোকানদার, কেউ রিকশাচালক বা ঘোড়াগাড়ির চালক। অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। তবে তাঁদের মন ছিল প্রাণরসে ভরপুর। মজার মজার কাহিনী বলাটা তাঁদের জন্মগত অভ্যাস। এ সহজাত রসবোধের কারণে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে আনন্দের আবহ সৃষ্টি হতো। শত সমস্যায় জর্জরিত জীবনে হাসির ফল্গুধারা বয়ে যেত।
ঢাকার আদি অধিবাসীর এ রঙ্গরসের উদ্দেশ্য ছিল নিজে আনন্দ পাওয়া ও অন্যকে আনন্দ দেওয়া। অনেক সময় যাঁকে নিয়ে রসিকতা করা হতো, তিনিও আনন্দ পেতেন। ঢাকার আদি বাসিন্দাদের এ রসিকতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ছিল গতানুগতিক রসিকতা, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। অপরটি হচ্ছে, সংঘটিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক রসিকতা। গতানুগতিক রসিকতার মধ্যে ছিল হোটেলে চায়ের কাপে মাছি পড়ার কথা। হোটেল মালিককে এ বিষয়ে অভিযোগ করলে মালিক উত্তর দিতেন, 'তিন পয়সার চায়ে মাক্ষি পড়ব না তো কি আত্তি (হাতি) পড়ব!' বর্ষাকালে বাড়ির ছাদ দিয়ে পানি পড়লে ভাড়াটিয়া তা মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাড়ির মালিক উত্তর দিতেন, 'মাসিক তিন টাকা ভাড়ার বাড়ির ছাদ দিয়া পানি পড়ব না তো কি শরবত পড়ব!' এ রকম বহু রসিকতা আছে, যা ছিল গতানুগতিক রসিকতা।
গতানুগতিক রসিকতার বাইরে ঢাকার আদি অধিবাসীর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তাৎক্ষণিক রসিকতা। যেকোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিকে বাকচাতুর্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা ছিল তাঁদের সহজাত গুণ। উত্তর যেন তাঁদের ঠোঁটের কোণে লেগেই থাকত। শুধু ঘটনা ঘটার অপেক্ষা। যেমন_এক বৃদ্ধ মাছ কেনার জন্য মাছের বাজার ঘুরছে। হঠাৎ বৃদ্ধ পিছলে পড়ে গেলে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। তা দেখে বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে মাটিতে সজোরে লাথি মেরে নিজে নিজেই বলতে থাকেন, 'যখন জুয়ান আছিলাম তখন মাটিতে ফালাইতে পারো নাই। অখন বুড়া অইছি, ফালাইবাই তো।' বৃদ্ধের এমন বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে আবার সবাই হেসে ওঠে। ঢাকার আদি বাসিন্দাদের রসবোধের আরেকটি উদাহরণ_রিকশার চেন বারবার পড়ে যাচ্ছে তাই রিকশারোহী বিরক্ত হচ্ছেন। যাত্রীর এ বিরক্ত দূর করার জন্য রিকশাচালক চেন ওঠানোর সময় নিজে নিজেই বলতে থাকে_'বউ পুরান অইয়া গেলে যেমন মাথা থাইকা ঘুমটা পইড়া যায়, চেইনটাও বউয়ের মতো পুরান হইয়া গেছে, এর লেইগা বারবার পইড়া যাইতাছে। মহাজনেরে কইয়া আইজই চেইনটা বদলাইয়া লমু।'
শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ হালকা করার ব্যাপারেও ঢাকার আদি অধিবাসীর জুড়ি নেই। যেমন_এক ব্যক্তি মারা যাওয়ায় তাঁকে কবরস্থানে আম গাছের তলে দাফন করে আসা হয়। মৃতের পরিবারের সবাই এখন শোকে নিমজ্জিত। এ পরিবেশ হালকা করার জন্য মৃতের ছেলের এক বন্ধু বলে ওঠে, 'আবে হালা তোর বাবারে আম গাছের তলায় কবর দিছস ক্যান। রোদে তো কষ্ট পাইব, বটগাছের তলায় কবর দিলে ছায়া বি পাইত। খুশি বি থাকত।' এমন কথায় পরিবেশ নিমিষে হালকা হয়ে যায়।
ঢাকার আদি অধিবাসী কথার মাধুর্য বাড়ানোর জন্য প্রায়ই হালা (শালা) শব্দটি ব্যবহার করে। এমনকি বাবা হালা, মা হালা, পোলা হালাও বলে। যেমন_গৃহশিক্ষক পড়াতে না আশায় এক ছাত্রী তার প্রতিবেশী বান্ধবীকে জানালা দিয়ে বলে, 'সার হালা মনে অইতাছে আইজকা পড়াইতে আইব না। চল লালবাগ কিল্লা দেইখা আহি।'
ঢাকার আদি অধিবাসীর এ রসবোধ সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন প্রয়াত সাহিত্যিক এম আর আখতার মুকুল। তিনি '৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার আদিবাসীদের বাচনভঙ্গি ও রসবোধের ধারায় চরমপত্র পাঠ করে একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতা প্রত্যাশীদের আলোড়িত ও উৎসাহিত করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্র অনুষ্ঠানটি ছিল তখন সবচেয়ে জনপ্রিয়।
ঢাকার আদি অধিবাসীর এ রসবোধটা অতুলনীয়। বিশ্বের নানা দেশে অঞ্চলবিশেষের আদি অধিবাসীর মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য বিরল। সেদিক থেকেও তাঁরা এক গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী। তবে সে বৈশিষ্ট্যে আজ ভাটা পড়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁরা অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, শিক্ষা-দীক্ষায়ও এগিয়েছেন। কিন্তু গর্বের সেই রসবোধটা আজ লাখো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেছে।

No comments:

Post a Comment