অতিথি ও পর্যটকদের চোখে ঢাকা
সৈ য় দ আ ব দা ল আ হ ম দ
চাঁদ জয় করে পৃথিবীতে ফিরে এসে তিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। ভ্রমণের অংশ হিসেবে তাঁরা ঢাকায়ও এসেছিলেন। ঊনষাট সালের সেই ঐতিহাসিক দিনটিতে তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দরে ঢাকার কৌতূহলী মানুষকে নীল আর্মস্ট্রং ও তার সঙ্গীরা চন্দ্র বিজয়ের গল্প শুনিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, ‘তোমাদের ছিমছাম নিরিবিলি ঢাকা শহরটি অপূর্ব।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েকবারই এসেছেন ঢাকায়। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকায় এলে বুড়িগঙ্গা নদীর বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন করোনেশন পার্কে কবিকে দেয়া হয় জমকালো সংবর্ধনা। ‘তুরাগ’ নামে ঢাকার নবাবের বজরাটি কবির বিশ্রামের জন্য সুসজ্জিত করে রাখা হয়েছিল। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঢাকার মানুষের আতিথেয়তায় অভিভূত হয়েছিলেন কবি। এরপর ঢাকার বলধা গার্ডেন দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে ফুল আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কাটিয়েছিলেন। ধারণা করা হয় ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি বলধা গার্ডেনে বসেই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
কিংবদন্তির মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ঢাকায় এসেছিলেন সত্তরের দশকে। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে দেখতে ঢাকা স্টেডিয়াম উপচে পড়েছিল মানুষ। সেদিন তিনি ঢাকার মানুষকে আনন্দ দেয়ার জন্য মুষ্টিযুদ্ধের একটি প্রদর্শনী ম্যাচও খেলেছিলেন। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে তার হাতে ঢাকার চাবি তুলে দেয়া হয়েছিল। আর মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, ‘ঢাকায় এসে আমি মুগ্ধ, এটা আমার প্রিয় শহর।’
দুনিয়ার এমন অনেক বিখ্যাত মানুষ ঢাকায় অতিথি হয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে যেমন আছেন রাষ্ট্রনায়ক, রাজা-রানী, শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, অর্থনীতিবিদ ও বিজ্ঞানী; তেমনি আছেন বিশ্বের অনেক পর্যটকও। জাতিসংঘের দুজন মহাসচিব ডক্টর কুর্ট ওয়াল্ডহেইম ও জেভিয়ার পেরেজ দ্য কুয়েলার ঢাকা সফর করেছেন। তৃতীয়বার জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে এসেছেন কফি আনান। ঢাকায় এসেছেন মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। এসেছেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম, মাদার তেরেসা, অমর্ত্য সেন, গ্যুন্টার গ্রাস। এসেছেন হলিউডের নায়িকা অড্রে হেপবার্ন, গানের অতিথি কুন্দন লাল সায়গল, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, রবি শঙ্কর, কানন বালা, মেহেদী হাসান, নূরজাহান, গোলাম আলী এমনি আরও অনেকে।
একসময় বুড়িগঙ্গা তীরের এই বিচিত্র নগরীকে প্রাচ্যের রানী ঢাকা নামে ডাকা হতো। এই নগরীর বয়স চারশ’ বছর হয়ে গেল। পরিবর্তনশীল ভাগ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে ওঠা এই নগরী আকর্ষণ করেছে ওইসব বিদেশি পর্যটক আর দুনিয়ার বিখ্যাত সব মানুষকে। এই নগরীর মায়াবী আকর্ষণে তারা ছুটে এসেছেন এখানে হাজার হাজার মাইল দুর্গম পথ পেরিয়ে। এদের কেউ এসেছেন মোগল যুগে, কেউ এসেছেন ব্রিটিশ যুগে। আবার কেউবা পাকিস্তান শাসনামলে কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমানকালে ঢাকা সফর করেছেন। অনেকে লিখেছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা, এই নগরীর জীবনধারার কথা।
ভ্রমণকারী পর্তুগিজ যাজক সিবাস্টিয়ান ম্যানরিখ ১৬৪০ সালের দিকে ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকা শহরে তাঁর অবস্থানকাল ছিল ২৭ দিন। এই অল্প কয়দিনে তিনি যা দেখেছেন এবং শুনেছেন তা লিখে গেছেন। ওই সময়ের শহরের বর্ণনা দিতে গিয়ে ম্যানরিখ মন্তব্য করেন, ‘এটিই হচ্ছে বাংলার প্রধান শহর আর দেশের সবচেয়ে উচ্চ পদাধিকারী নবাব বা ভাইসরয় বা প্রতিনিধির কার্যস্থল, যাকে সম্রাট নিয়োগ দেন। এই প্রতিনিধিদের দায়িত্ব সম্রাট বেশ কয়েকবারই তার নিজস্ব কোনো সন্তানের ওপরই অর্পণ করেন। এই নগরীটি বিরাট এবং অতি সুন্দর এক সমতল ভূমিতে এবং এখানে ফলবান গঙ্গা (বুড়িগঙ্গা) নদীর পাড়ে অবস্থিত। এর পাড় ঘেঁষেই শহরটি প্রায় দেড়লীগ (প্রায় সোয়া পাঁচ মাইল)-এর বেশি স্থান পর্যন্ত প্রসারিত। এই শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে বিচিত্র জাতির মানুষ আসেন। নানান ধরনের পণ্যের বিরাট ব্যবসা এখানে হয়। এসব পণ্য বেশিরভাগই এ অঞ্চলের উত্তম ও অতি উর্বর ভূমি থেকেই উত্পাদিত হয়। এই ব্যবসা-বাণিজ্য নগরটির জন্য এত ধন-সম্পত্তি এনেছে যা ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। বিশেষ করে এখানকার যাত্রীদের (মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের) বাড়িতে যে পরিমাণ টাকা আছে তা গণনা করা অসম্ভব ভেবে এগুলো ওজন করা হয়। আমাকে বলা হয়েছে, গাঙ্গেয় এই বিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র এবং এর উপকণ্ঠে দুই লাখেরও অধিক লোক বাস করে। বিস্মিত হওয়ার আরও কারণ রয়েছে। আর তা হলো প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের বিপুল সরবরাহ। এর বিভিন্ন বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই, যা মানুষের কামনার বাইরে। এই নগর থেকে সম্রাট এবং অন্যান্য মোগল শাসনকর্তা যে পরিমাণ আর্থিক সুবিধা লাভ করেন তা অবিশ্বাস্য। শুধু এটুকুই বলতে চাই, কেবল পান বা ভারতীয় পাতা থেকেই তারা প্রতিদিন ৪ হাজার রুপি শুল্ক পেয়ে থাকে। ম্যানরিখ আরও উল্লেখ করেন, ‘এই অঞ্চলেই সবচেয়ে সূক্ষ্ম এবং উত্কৃষ্ট মসলিন তৈরি হয়। ৫০ থেকে ৬০ গজ লম্বা আর ৭ থেকে ৮ হাত চওড়া এ কাপড়গুলোতে সোনালি ও রুপালি রঙের রেশমের পাড় আছে। এসব বস্ত্র এত সূক্ষ্ম যে ব্যবসায়ীরা এক হাত লম্বা ফাঁকা বাঁশের ভেতরে এগুলো ঢুকিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিতরণের জন্য নিরাপদে বহন করতে পারত। আর এরূপ দৃঢ়ভাবে স্থাপিত করে এগুলো খোরাসান, পারস্য, তুরস্কসহ দূরদূরান্তের দেশে নিয়ে যায়। ঢাকার বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে ম্যানরিখ লিখেছেন, এটা এত ব্যাপক ছিল যে, একশ’রও বেশি পণ্যভর্তি জাহাজ বিদেশে চালান যেত। রফতানি পণ্যের মধ্যে কাপড়, চাল, চিনি, তেল ছিল প্রধান।
১৬৬৩ সালে ইতালীয় পর্যটক ও ঐতিহাসিক নিকোলো মানুচ্চি ঢাকায় আসেন। স্বল্পদিন অবস্থান করেন তিনি। ঢাকাকে তিনি মাঝারি ধরনের শহর হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে আয়তনের তুলনায় তখন লোকসংখ্যা ছিল বেশি। তিনি লিখেছেন, ঢাকার অধিকাংশ বাড়িঘরই খড়ের তৈরি। তবে কিছু কিছু ইটের তৈরি বাড়িঘরও ছিল। সেগুলো বেশিরভাগই বিদেশিদের। বিদেশি বাসিন্দাদের মধ্যে ইংরেজ, ওলন্দাজ এবং পর্তুগীজদের সংখ্যা ছিল বেশি।
ফরাসি ব্যবসায়ী পর্যটক টাভার্নিয়ার ১৬৬৬ সালে প্রাচ্যের রহস্যনগরী ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকায় তাঁর অবস্থান ছিল মাত্র ষোল দিনের। এ স্বল্পকালীন অবস্থানে তিনি দু’বার নবাব শায়েস্তা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং ফ্রান্স থেকে তিনি যেসব অলঙ্কার ও রত্নাদি এনেছিলেন তা বিক্রি করেন। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি প্রায় ১১ হাজার টাকা মূল্যের পণ্যসামগ্রী ক্রয় করেন। টাভার্নিয়ার ঢাকাকে অনেক বড় শহর বলে উল্লেখ করেন। দৈর্ঘ্য ছয় মাইলেরও বেশি। শহরের স্থানীয় বাসিন্দাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, এদের অধিকাংশ কাঠমিস্ত্রি, নৌকা তৈরি করা এদের প্রধান কাজ। বাঁশ ও কাদামাটির তৈরি বাড়িঘরে এরা বসবাস করে। টাভার্নিয়ার এ বাড়িগুলোকে মুরগির ঘর বলে মন্তব্য করেন। টাভার্নিয়ার ঢাকাকে একটি বৃহত্ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করে লেখেন, মোগল সাম্রাজ্যের ১২টি বাণিজ্য কেন্দ্রের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।
১৮২৪ সালে কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড হেবার ঢাকা শহরে আসেন। এখানে ২২ দিন তিনি অবস্থান করেন। হেবারের ভাষায় : যে নদীর তীরে ঢাকা অবস্থিত তার রূপ অনেক বদলে গেছে। রেনেলের মানচিত্রের সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ওই সময় এই নদীটি ছিল সরু কিন্তু এখন এমনকি গ্রীষ্মকালেও কলকাতার হুগলি নদীর চেয়ে কোনো অংশে ছোট নয়। ঢাকায় হেবার তত্কালীন কালেক্টর মি. মাস্টারের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তার কাছ থেকে শোনা ঢাকার বর্ণনা থেকে হেবার লিখেছেন, ঢাকা এখন প্রাচীন গৌরবের ধ্বংসাবশেষ মাত্র। এর বাণিজ্য পূর্বাপেক্ষা ষাট ভাগ কমে গেছে। ঢাকার সুরম্য অট্টালিকা, শাহ জাহাঙ্গীর নির্মিত দুর্গ, তার তৈরি মসজিদ, প্রাচীন নবাবদের রাজপ্রাসাদ, ওলন্দাজ, ফরাসি এবং পর্তুগিজদের ফ্যাক্টরি ও চার্চ সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং জঙ্গলে ঢেকে গেছে। মোগল যুগের ঢাকা থেকে কোম্পানি আমলের ঢাকার অনেক পার্থক্য তার বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়।
১৮৪০ সালে ঢাকায় আসেন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সের লে. কর্নেল সিজেসি ডেভিডসন। দূর থেকে আবছাভাবে ডেভিডসনের চোখে পড়ল ঢাকা। চারদিকে ঘন কুয়াশা। এর মধ্যে যে জিনিসটি নজরে এলো, তা হলো শহরের বিপরীতে নদীর পশ্চিম দিকে উঁচু ও স্থায়ী এক দোতলা বাড়ি। শহরটি বুড়িগঙ্গার পূর্ব তীরে। লম্বায় হবে প্রায় দুই মাইল। তিন চার মাইল দূর থেকে বা টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেও ভারি সুন্দর দেখায় শহরটি। ঢাকায় পা রেখে ডেভিডসন দেখলেন, এক টাকা খরচ করলে পাওয়া যায় ২৫৬টি কমলা আর দুই টাকা খরচ করলে একটি বেহালা। দিন রাত সারাক্ষণ ঢাকায় শোনা যায় বেহালার সুর। আবার এও দেখলেন, অরণ্য গ্রাস করছে শহর। ডেভিডসন লিখেছেন, শহর ঘিরে আছে যে জঙ্গল তা এড়িয়ে চলবেন, বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময়। এ বিষয়ে আমি তাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। ওই সময় জঙ্গল ও শহরের সীমান্ত পেরোবার বা শহরে ঢোকার সময় শরীর হঠাত্ শিউরে ওঠে।
ঊনিশ শতকের তিরিশের দশকে সিভিল সার্জন হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন ডাক্তার জেমস টেইলর। পরের বছর ‘টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ঢাকা’ পুস্তক আকারে বের হয়। টেইলর ঢাকা সম্পর্কে লিখেছেন, ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা যেখানে মিলেছে, তার প্রায় মাইল আটের ওপরে বুড়িগঙ্গার উত্তরে অবস্থিত ঢাকা। নদীটি গভীর ও উপযোগী বড় বড় নৌকা চলাচলের। বর্ষাকালে নদী ভরে যায় এবং বড় বড় মিনার ও অট্টালিকাশোভিত ঢাকা নগরীকে মনে হয় ভেনিসের মতো।
সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন ব্রাদার রবার্ট। প্রথম ঢাকা আসেন ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে, নদীপথে কলকাতা থেকে। সে সময় ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সৈন্যরা ঢাকা থেকে চলে যাচ্ছিল। ১৯৬৮ সালে তিনি সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে যোগ দেন। আমেরিকান নাগরিক ব্রাদার রবার্ট ১৯৭৫ সালে বর্ণনা করেছিলেন তার ঢাকার অভিজ্ঞতা : ‘আমি প্রথম এসে যে ঢাকাকে দেখেছি ঢাকা এখন তার চাইতে অনেক বিস্তৃত, অনেক সফিসটিকেটেড। প্রথম ঢাকায় এসে একটিমাত্র বিশাল রাস্তা দেখেছি, সেটি জনসন রোড। নদী থেকে যুদ্ধের সরঞ্জাম বিমানবন্দরে নেয়ার জন্য একটা পথ সে সময় তৈরি করা হয়েছিল। স্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়ায়। রমনা এলাকায় গোটাকয়েক দালানকোঠা ছিল। তেজগাঁও বিমানবন্দর সে সময় যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েছিল। মগবাজার তখন এক গ্রামীণ হাট মাত্র। শুধু আহসান মঞ্জিলই ছিল হ্যান্ডসাম বিল্ডিং। নদীতে লঞ্চ দেখিনি কখনও। স্টিমার যেত গোয়ালন্দ পর্যন্ত। নদীতে চলাচলের একমাত্র উপায় ছিল গয়না নৌকা। ইসলামপুরের কয়টা পথ বাদে আর সব পথ ছিল সরু। ধোলাইখাল ছিল। সব মিলিয়ে সে সময়ের ঢাকা মনে হয়েছে ইন্টারেস্টিং। অনেক ভিড় ছিল না, অনেক যানবাহন ছিল না। সে সময় যদিও ইলেকট্রিসিটি ছিল। তবু খুব কম দোকানে বৈদ্যুতিক আলো ছিল। প্রায় সব দোকানে রাতে জ্বলত কুপিবাতি। রমনা, তেজগাঁও এলাকা সে সময় পুরনো ঢাকা থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। টঙ্গী ছিল ছোট্ট একটা এলাকা। সেকালেও যানবাহন বলতে পথে দেখা যেত শুধুই এক্কাগাড়ি। আমেরিকানরা যাওয়ার সময় বিস্তর যুদ্ধের ট্রাক নিলামে বেচে গিয়েছিল। সেগুলোকে রদবদল করে বাস বানিয়ে নামানো হলো ঢাকার পথে। রিকশা ছিল না একদম। ট্যাক্সি দেখেছি কিনা মনে করতে পারি না। ঢাকা থেকে বাইরে যাওয়ার একমাত্র সড়ক ছিল নারায়ণগঞ্জের দিকে। ট্রেন ও গয়না নৌাকা ছাড়া বাইরে যাওয়ার পথ ছিল না। ওরিয়েন্ট এয়ার বলে একটা বেসরকারি বিমান কোম্পানিই বোধ হয় প্রথম ঢাকায় বিমানের সার্ভিস প্রবর্তন করে। পরে এলো পিআইএ।
সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন ব্রাদার হোবার্ট। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হোবার্ট ঢাকাকে দেখেছেন ১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৭৫ সালে ঢাকা সম্পর্কে তার বর্ণনা : সে সময় ভিক্টোরিয়া পার্কের আশপাশই ছিল সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকা। কেনাকাটা করতে মানুষ আসত চকবাজারে। এখানকার সাহেব-সুবাদের মতে, তখন কেউ নিউমার্কেটে যেত না। সেকালের সিনেমা হল ব্রিটানিয়ার পাশ দিয়ে নিউমার্কেট যাওয়ার একটা সরু পথ ছিল। তার আশপাশ কেবল জঙ্গলে ভরা। লাল ইটের বাড়িগুলোতে বিলেতি সাহেবরা থাকতেন। গুলিস্তান ছিল না। আজকের জিপিও ছিল পুরনো দালানে। মাছ পাওয়া যেত বিস্তর। আজকাল ঢাকায় সাপ দেখি না। আগে সাপ, বেজি, সজারু এই শহরে দেখা যেত অহরহ। শিম, বেগুন দু’আনা সের থেকে দশ পয়সা বাড়লে, ঢাকার মানুষ মাথায় হাত দিত। দু’আনা দিয়ে তরমুজ কিনে ভাবত হয়তো ঠকেছি। বিয়ের যৌতুক হিসেবে তখনও ট্রানজিস্টর আসেনি। জামাইরা প্রথমে দাবি করত রুমাল। তারপর বিয়ের বাজারে একটি র্যালি সাইকেল। মোঘল সুবাদার ইসলাম খাঁ ১৬০৮ সালে মতান্তরে ১৬১০ সালে ঢাকায় এসেছিলেন। সে থেকেই ঢাকার প্রতিষ্ঠাকাল ধরা হয়। যদিও ঐতিহাসিক অধ্যাপক হাসান দানীর মতে, ঢাকার বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি। কলকাতার অনেক আগের শহর এই ঢাকা। ঢাকা এখন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। এর আগে এই ঢাকা সুবা-বাংলার রাজধানী এবং দু’বার প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছে। স্বাধীন দেশের রাজধানীরূপে বিগত ৩৬ বছরে ঢাকার পরিধি অনেক বেড়েছে। বেড়েছে জনসংখ্যাও। বিশ্বখ্যাত অতিথিরা আসছেন এই নগরীতে। মাত্র কয়েক বছর আগে এই নগরীর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বিশ্বের সেরা ধনী মানুষ বিল গেটস। নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় এসেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। দিল্লি থেকে এয়ারফোর্স-১-এ করে আসার সময় আকাশ থেকে তিনি বললেন, ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ আপনাদের দেশটি ও রাজধানী শহর ঢাকা খুব চমত্কার। এই ঐতিহাসিক নগরীতে আসতে পেরে আমি গর্বিত।’ প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের আগে এসেছিলেন তার পত্নী যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটন। তার সম্মানে ২৯ হেয়ার রোডে (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়) রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। অনুষ্ঠান শেষ করে গাড়িতে ওঠার আগে সাংবাদিকদের হিলারি ক্লিনটন বললেন, ঢাকার স্মৃতি আমি ভুলব না। আপনারা খুবই সৌভাগ্যবান। আপনাদের একজন নারী প্রধানমন্ত্রী এবং আরেকজন নারী বিরোধীদলীয় নেত্রী। এ ব্যাপারে আমাদের দেশ এখনও রক্ষণশীল। নারীরা এ পর্যায়ে আসতে পারেনি। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। আর বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। হিলারি ক্লিনটন তার আত্মস্মৃতি নিয়ে যে বই লিখেছেন সেখানেও আছে ঢাকার কথা। এ নগরীতে পিঁপড়ের সারির মতো এত মানুষের উপস্থিতির কথা তিনি তুলে ধরেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও দু’বার ঢাকায় আসেন। একবার তিনি তার পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় করে রমনা পার্কের সামনের রাস্তায় বেড়িয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার তিনি মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে পাখির কলরব আর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন।
কিংবদন্তির গায়ক কুন্দন লাল সায়গল ঢাকায় এসে ডিমলার গাড়ি আর ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় তিনি গেয়েছেন, ‘আমার বীণায় গান আছে, আর তোমার বীণায় সুর আছে গো সুর আছে।’ কানন বালা ঢাকায় এসে ‘আমি বন ফুল গো’ গানটি গেয়ে ঢাকার মানুষকে অভিভূত করেছিলেন।
আশির দশকে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঢাকায় এসে বলেছিলেন, এই ঐতিহাসিক নগরী আমার মনে দাগ কেটেছে। ট্রেনে করে ঢাকা থেকে রানী গিয়েছিলেন গাজীপুরের বৈরাগীরচালা গ্রামে। সেখানে তিনি ঢেঁকিতে ধান ভানা, মুড়ি ভাজা ও মুরগি পালনসহ মানুষের জীবনধারা উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা ঢাকায় এসে শান্তির বাণী শুনিয়ে গেছেন। চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই ঢাকা নগরী আমাদের গর্বের প্রিয় নগরী।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েকবারই এসেছেন ঢাকায়। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকায় এলে বুড়িগঙ্গা নদীর বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন করোনেশন পার্কে কবিকে দেয়া হয় জমকালো সংবর্ধনা। ‘তুরাগ’ নামে ঢাকার নবাবের বজরাটি কবির বিশ্রামের জন্য সুসজ্জিত করে রাখা হয়েছিল। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঢাকার মানুষের আতিথেয়তায় অভিভূত হয়েছিলেন কবি। এরপর ঢাকার বলধা গার্ডেন দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে ফুল আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কাটিয়েছিলেন। ধারণা করা হয় ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি বলধা গার্ডেনে বসেই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
কিংবদন্তির মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ঢাকায় এসেছিলেন সত্তরের দশকে। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে দেখতে ঢাকা স্টেডিয়াম উপচে পড়েছিল মানুষ। সেদিন তিনি ঢাকার মানুষকে আনন্দ দেয়ার জন্য মুষ্টিযুদ্ধের একটি প্রদর্শনী ম্যাচও খেলেছিলেন। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে তার হাতে ঢাকার চাবি তুলে দেয়া হয়েছিল। আর মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, ‘ঢাকায় এসে আমি মুগ্ধ, এটা আমার প্রিয় শহর।’
দুনিয়ার এমন অনেক বিখ্যাত মানুষ ঢাকায় অতিথি হয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে যেমন আছেন রাষ্ট্রনায়ক, রাজা-রানী, শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, অর্থনীতিবিদ ও বিজ্ঞানী; তেমনি আছেন বিশ্বের অনেক পর্যটকও। জাতিসংঘের দুজন মহাসচিব ডক্টর কুর্ট ওয়াল্ডহেইম ও জেভিয়ার পেরেজ দ্য কুয়েলার ঢাকা সফর করেছেন। তৃতীয়বার জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে এসেছেন কফি আনান। ঢাকায় এসেছেন মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। এসেছেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম, মাদার তেরেসা, অমর্ত্য সেন, গ্যুন্টার গ্রাস। এসেছেন হলিউডের নায়িকা অড্রে হেপবার্ন, গানের অতিথি কুন্দন লাল সায়গল, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, রবি শঙ্কর, কানন বালা, মেহেদী হাসান, নূরজাহান, গোলাম আলী এমনি আরও অনেকে।
একসময় বুড়িগঙ্গা তীরের এই বিচিত্র নগরীকে প্রাচ্যের রানী ঢাকা নামে ডাকা হতো। এই নগরীর বয়স চারশ’ বছর হয়ে গেল। পরিবর্তনশীল ভাগ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে ওঠা এই নগরী আকর্ষণ করেছে ওইসব বিদেশি পর্যটক আর দুনিয়ার বিখ্যাত সব মানুষকে। এই নগরীর মায়াবী আকর্ষণে তারা ছুটে এসেছেন এখানে হাজার হাজার মাইল দুর্গম পথ পেরিয়ে। এদের কেউ এসেছেন মোগল যুগে, কেউ এসেছেন ব্রিটিশ যুগে। আবার কেউবা পাকিস্তান শাসনামলে কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমানকালে ঢাকা সফর করেছেন। অনেকে লিখেছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা, এই নগরীর জীবনধারার কথা।
ভ্রমণকারী পর্তুগিজ যাজক সিবাস্টিয়ান ম্যানরিখ ১৬৪০ সালের দিকে ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকা শহরে তাঁর অবস্থানকাল ছিল ২৭ দিন। এই অল্প কয়দিনে তিনি যা দেখেছেন এবং শুনেছেন তা লিখে গেছেন। ওই সময়ের শহরের বর্ণনা দিতে গিয়ে ম্যানরিখ মন্তব্য করেন, ‘এটিই হচ্ছে বাংলার প্রধান শহর আর দেশের সবচেয়ে উচ্চ পদাধিকারী নবাব বা ভাইসরয় বা প্রতিনিধির কার্যস্থল, যাকে সম্রাট নিয়োগ দেন। এই প্রতিনিধিদের দায়িত্ব সম্রাট বেশ কয়েকবারই তার নিজস্ব কোনো সন্তানের ওপরই অর্পণ করেন। এই নগরীটি বিরাট এবং অতি সুন্দর এক সমতল ভূমিতে এবং এখানে ফলবান গঙ্গা (বুড়িগঙ্গা) নদীর পাড়ে অবস্থিত। এর পাড় ঘেঁষেই শহরটি প্রায় দেড়লীগ (প্রায় সোয়া পাঁচ মাইল)-এর বেশি স্থান পর্যন্ত প্রসারিত। এই শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে বিচিত্র জাতির মানুষ আসেন। নানান ধরনের পণ্যের বিরাট ব্যবসা এখানে হয়। এসব পণ্য বেশিরভাগই এ অঞ্চলের উত্তম ও অতি উর্বর ভূমি থেকেই উত্পাদিত হয়। এই ব্যবসা-বাণিজ্য নগরটির জন্য এত ধন-সম্পত্তি এনেছে যা ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। বিশেষ করে এখানকার যাত্রীদের (মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের) বাড়িতে যে পরিমাণ টাকা আছে তা গণনা করা অসম্ভব ভেবে এগুলো ওজন করা হয়। আমাকে বলা হয়েছে, গাঙ্গেয় এই বিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র এবং এর উপকণ্ঠে দুই লাখেরও অধিক লোক বাস করে। বিস্মিত হওয়ার আরও কারণ রয়েছে। আর তা হলো প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের বিপুল সরবরাহ। এর বিভিন্ন বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই, যা মানুষের কামনার বাইরে। এই নগর থেকে সম্রাট এবং অন্যান্য মোগল শাসনকর্তা যে পরিমাণ আর্থিক সুবিধা লাভ করেন তা অবিশ্বাস্য। শুধু এটুকুই বলতে চাই, কেবল পান বা ভারতীয় পাতা থেকেই তারা প্রতিদিন ৪ হাজার রুপি শুল্ক পেয়ে থাকে। ম্যানরিখ আরও উল্লেখ করেন, ‘এই অঞ্চলেই সবচেয়ে সূক্ষ্ম এবং উত্কৃষ্ট মসলিন তৈরি হয়। ৫০ থেকে ৬০ গজ লম্বা আর ৭ থেকে ৮ হাত চওড়া এ কাপড়গুলোতে সোনালি ও রুপালি রঙের রেশমের পাড় আছে। এসব বস্ত্র এত সূক্ষ্ম যে ব্যবসায়ীরা এক হাত লম্বা ফাঁকা বাঁশের ভেতরে এগুলো ঢুকিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিতরণের জন্য নিরাপদে বহন করতে পারত। আর এরূপ দৃঢ়ভাবে স্থাপিত করে এগুলো খোরাসান, পারস্য, তুরস্কসহ দূরদূরান্তের দেশে নিয়ে যায়। ঢাকার বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে ম্যানরিখ লিখেছেন, এটা এত ব্যাপক ছিল যে, একশ’রও বেশি পণ্যভর্তি জাহাজ বিদেশে চালান যেত। রফতানি পণ্যের মধ্যে কাপড়, চাল, চিনি, তেল ছিল প্রধান।
১৬৬৩ সালে ইতালীয় পর্যটক ও ঐতিহাসিক নিকোলো মানুচ্চি ঢাকায় আসেন। স্বল্পদিন অবস্থান করেন তিনি। ঢাকাকে তিনি মাঝারি ধরনের শহর হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে আয়তনের তুলনায় তখন লোকসংখ্যা ছিল বেশি। তিনি লিখেছেন, ঢাকার অধিকাংশ বাড়িঘরই খড়ের তৈরি। তবে কিছু কিছু ইটের তৈরি বাড়িঘরও ছিল। সেগুলো বেশিরভাগই বিদেশিদের। বিদেশি বাসিন্দাদের মধ্যে ইংরেজ, ওলন্দাজ এবং পর্তুগীজদের সংখ্যা ছিল বেশি।
ফরাসি ব্যবসায়ী পর্যটক টাভার্নিয়ার ১৬৬৬ সালে প্রাচ্যের রহস্যনগরী ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকায় তাঁর অবস্থান ছিল মাত্র ষোল দিনের। এ স্বল্পকালীন অবস্থানে তিনি দু’বার নবাব শায়েস্তা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং ফ্রান্স থেকে তিনি যেসব অলঙ্কার ও রত্নাদি এনেছিলেন তা বিক্রি করেন। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি প্রায় ১১ হাজার টাকা মূল্যের পণ্যসামগ্রী ক্রয় করেন। টাভার্নিয়ার ঢাকাকে অনেক বড় শহর বলে উল্লেখ করেন। দৈর্ঘ্য ছয় মাইলেরও বেশি। শহরের স্থানীয় বাসিন্দাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, এদের অধিকাংশ কাঠমিস্ত্রি, নৌকা তৈরি করা এদের প্রধান কাজ। বাঁশ ও কাদামাটির তৈরি বাড়িঘরে এরা বসবাস করে। টাভার্নিয়ার এ বাড়িগুলোকে মুরগির ঘর বলে মন্তব্য করেন। টাভার্নিয়ার ঢাকাকে একটি বৃহত্ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করে লেখেন, মোগল সাম্রাজ্যের ১২টি বাণিজ্য কেন্দ্রের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।
১৮২৪ সালে কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড হেবার ঢাকা শহরে আসেন। এখানে ২২ দিন তিনি অবস্থান করেন। হেবারের ভাষায় : যে নদীর তীরে ঢাকা অবস্থিত তার রূপ অনেক বদলে গেছে। রেনেলের মানচিত্রের সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ওই সময় এই নদীটি ছিল সরু কিন্তু এখন এমনকি গ্রীষ্মকালেও কলকাতার হুগলি নদীর চেয়ে কোনো অংশে ছোট নয়। ঢাকায় হেবার তত্কালীন কালেক্টর মি. মাস্টারের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তার কাছ থেকে শোনা ঢাকার বর্ণনা থেকে হেবার লিখেছেন, ঢাকা এখন প্রাচীন গৌরবের ধ্বংসাবশেষ মাত্র। এর বাণিজ্য পূর্বাপেক্ষা ষাট ভাগ কমে গেছে। ঢাকার সুরম্য অট্টালিকা, শাহ জাহাঙ্গীর নির্মিত দুর্গ, তার তৈরি মসজিদ, প্রাচীন নবাবদের রাজপ্রাসাদ, ওলন্দাজ, ফরাসি এবং পর্তুগিজদের ফ্যাক্টরি ও চার্চ সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং জঙ্গলে ঢেকে গেছে। মোগল যুগের ঢাকা থেকে কোম্পানি আমলের ঢাকার অনেক পার্থক্য তার বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়।
১৮৪০ সালে ঢাকায় আসেন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সের লে. কর্নেল সিজেসি ডেভিডসন। দূর থেকে আবছাভাবে ডেভিডসনের চোখে পড়ল ঢাকা। চারদিকে ঘন কুয়াশা। এর মধ্যে যে জিনিসটি নজরে এলো, তা হলো শহরের বিপরীতে নদীর পশ্চিম দিকে উঁচু ও স্থায়ী এক দোতলা বাড়ি। শহরটি বুড়িগঙ্গার পূর্ব তীরে। লম্বায় হবে প্রায় দুই মাইল। তিন চার মাইল দূর থেকে বা টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেও ভারি সুন্দর দেখায় শহরটি। ঢাকায় পা রেখে ডেভিডসন দেখলেন, এক টাকা খরচ করলে পাওয়া যায় ২৫৬টি কমলা আর দুই টাকা খরচ করলে একটি বেহালা। দিন রাত সারাক্ষণ ঢাকায় শোনা যায় বেহালার সুর। আবার এও দেখলেন, অরণ্য গ্রাস করছে শহর। ডেভিডসন লিখেছেন, শহর ঘিরে আছে যে জঙ্গল তা এড়িয়ে চলবেন, বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময়। এ বিষয়ে আমি তাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। ওই সময় জঙ্গল ও শহরের সীমান্ত পেরোবার বা শহরে ঢোকার সময় শরীর হঠাত্ শিউরে ওঠে।
ঊনিশ শতকের তিরিশের দশকে সিভিল সার্জন হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন ডাক্তার জেমস টেইলর। পরের বছর ‘টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ঢাকা’ পুস্তক আকারে বের হয়। টেইলর ঢাকা সম্পর্কে লিখেছেন, ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা যেখানে মিলেছে, তার প্রায় মাইল আটের ওপরে বুড়িগঙ্গার উত্তরে অবস্থিত ঢাকা। নদীটি গভীর ও উপযোগী বড় বড় নৌকা চলাচলের। বর্ষাকালে নদী ভরে যায় এবং বড় বড় মিনার ও অট্টালিকাশোভিত ঢাকা নগরীকে মনে হয় ভেনিসের মতো।
সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন ব্রাদার রবার্ট। প্রথম ঢাকা আসেন ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে, নদীপথে কলকাতা থেকে। সে সময় ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সৈন্যরা ঢাকা থেকে চলে যাচ্ছিল। ১৯৬৮ সালে তিনি সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে যোগ দেন। আমেরিকান নাগরিক ব্রাদার রবার্ট ১৯৭৫ সালে বর্ণনা করেছিলেন তার ঢাকার অভিজ্ঞতা : ‘আমি প্রথম এসে যে ঢাকাকে দেখেছি ঢাকা এখন তার চাইতে অনেক বিস্তৃত, অনেক সফিসটিকেটেড। প্রথম ঢাকায় এসে একটিমাত্র বিশাল রাস্তা দেখেছি, সেটি জনসন রোড। নদী থেকে যুদ্ধের সরঞ্জাম বিমানবন্দরে নেয়ার জন্য একটা পথ সে সময় তৈরি করা হয়েছিল। স্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়ায়। রমনা এলাকায় গোটাকয়েক দালানকোঠা ছিল। তেজগাঁও বিমানবন্দর সে সময় যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েছিল। মগবাজার তখন এক গ্রামীণ হাট মাত্র। শুধু আহসান মঞ্জিলই ছিল হ্যান্ডসাম বিল্ডিং। নদীতে লঞ্চ দেখিনি কখনও। স্টিমার যেত গোয়ালন্দ পর্যন্ত। নদীতে চলাচলের একমাত্র উপায় ছিল গয়না নৌকা। ইসলামপুরের কয়টা পথ বাদে আর সব পথ ছিল সরু। ধোলাইখাল ছিল। সব মিলিয়ে সে সময়ের ঢাকা মনে হয়েছে ইন্টারেস্টিং। অনেক ভিড় ছিল না, অনেক যানবাহন ছিল না। সে সময় যদিও ইলেকট্রিসিটি ছিল। তবু খুব কম দোকানে বৈদ্যুতিক আলো ছিল। প্রায় সব দোকানে রাতে জ্বলত কুপিবাতি। রমনা, তেজগাঁও এলাকা সে সময় পুরনো ঢাকা থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। টঙ্গী ছিল ছোট্ট একটা এলাকা। সেকালেও যানবাহন বলতে পথে দেখা যেত শুধুই এক্কাগাড়ি। আমেরিকানরা যাওয়ার সময় বিস্তর যুদ্ধের ট্রাক নিলামে বেচে গিয়েছিল। সেগুলোকে রদবদল করে বাস বানিয়ে নামানো হলো ঢাকার পথে। রিকশা ছিল না একদম। ট্যাক্সি দেখেছি কিনা মনে করতে পারি না। ঢাকা থেকে বাইরে যাওয়ার একমাত্র সড়ক ছিল নারায়ণগঞ্জের দিকে। ট্রেন ও গয়না নৌাকা ছাড়া বাইরে যাওয়ার পথ ছিল না। ওরিয়েন্ট এয়ার বলে একটা বেসরকারি বিমান কোম্পানিই বোধ হয় প্রথম ঢাকায় বিমানের সার্ভিস প্রবর্তন করে। পরে এলো পিআইএ।
সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন ব্রাদার হোবার্ট। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হোবার্ট ঢাকাকে দেখেছেন ১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৭৫ সালে ঢাকা সম্পর্কে তার বর্ণনা : সে সময় ভিক্টোরিয়া পার্কের আশপাশই ছিল সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকা। কেনাকাটা করতে মানুষ আসত চকবাজারে। এখানকার সাহেব-সুবাদের মতে, তখন কেউ নিউমার্কেটে যেত না। সেকালের সিনেমা হল ব্রিটানিয়ার পাশ দিয়ে নিউমার্কেট যাওয়ার একটা সরু পথ ছিল। তার আশপাশ কেবল জঙ্গলে ভরা। লাল ইটের বাড়িগুলোতে বিলেতি সাহেবরা থাকতেন। গুলিস্তান ছিল না। আজকের জিপিও ছিল পুরনো দালানে। মাছ পাওয়া যেত বিস্তর। আজকাল ঢাকায় সাপ দেখি না। আগে সাপ, বেজি, সজারু এই শহরে দেখা যেত অহরহ। শিম, বেগুন দু’আনা সের থেকে দশ পয়সা বাড়লে, ঢাকার মানুষ মাথায় হাত দিত। দু’আনা দিয়ে তরমুজ কিনে ভাবত হয়তো ঠকেছি। বিয়ের যৌতুক হিসেবে তখনও ট্রানজিস্টর আসেনি। জামাইরা প্রথমে দাবি করত রুমাল। তারপর বিয়ের বাজারে একটি র্যালি সাইকেল। মোঘল সুবাদার ইসলাম খাঁ ১৬০৮ সালে মতান্তরে ১৬১০ সালে ঢাকায় এসেছিলেন। সে থেকেই ঢাকার প্রতিষ্ঠাকাল ধরা হয়। যদিও ঐতিহাসিক অধ্যাপক হাসান দানীর মতে, ঢাকার বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি। কলকাতার অনেক আগের শহর এই ঢাকা। ঢাকা এখন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। এর আগে এই ঢাকা সুবা-বাংলার রাজধানী এবং দু’বার প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছে। স্বাধীন দেশের রাজধানীরূপে বিগত ৩৬ বছরে ঢাকার পরিধি অনেক বেড়েছে। বেড়েছে জনসংখ্যাও। বিশ্বখ্যাত অতিথিরা আসছেন এই নগরীতে। মাত্র কয়েক বছর আগে এই নগরীর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বিশ্বের সেরা ধনী মানুষ বিল গেটস। নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় এসেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। দিল্লি থেকে এয়ারফোর্স-১-এ করে আসার সময় আকাশ থেকে তিনি বললেন, ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ আপনাদের দেশটি ও রাজধানী শহর ঢাকা খুব চমত্কার। এই ঐতিহাসিক নগরীতে আসতে পেরে আমি গর্বিত।’ প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের আগে এসেছিলেন তার পত্নী যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটন। তার সম্মানে ২৯ হেয়ার রোডে (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়) রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। অনুষ্ঠান শেষ করে গাড়িতে ওঠার আগে সাংবাদিকদের হিলারি ক্লিনটন বললেন, ঢাকার স্মৃতি আমি ভুলব না। আপনারা খুবই সৌভাগ্যবান। আপনাদের একজন নারী প্রধানমন্ত্রী এবং আরেকজন নারী বিরোধীদলীয় নেত্রী। এ ব্যাপারে আমাদের দেশ এখনও রক্ষণশীল। নারীরা এ পর্যায়ে আসতে পারেনি। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। আর বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। হিলারি ক্লিনটন তার আত্মস্মৃতি নিয়ে যে বই লিখেছেন সেখানেও আছে ঢাকার কথা। এ নগরীতে পিঁপড়ের সারির মতো এত মানুষের উপস্থিতির কথা তিনি তুলে ধরেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও দু’বার ঢাকায় আসেন। একবার তিনি তার পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় করে রমনা পার্কের সামনের রাস্তায় বেড়িয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার তিনি মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে পাখির কলরব আর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন।
কিংবদন্তির গায়ক কুন্দন লাল সায়গল ঢাকায় এসে ডিমলার গাড়ি আর ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় তিনি গেয়েছেন, ‘আমার বীণায় গান আছে, আর তোমার বীণায় সুর আছে গো সুর আছে।’ কানন বালা ঢাকায় এসে ‘আমি বন ফুল গো’ গানটি গেয়ে ঢাকার মানুষকে অভিভূত করেছিলেন।
আশির দশকে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঢাকায় এসে বলেছিলেন, এই ঐতিহাসিক নগরী আমার মনে দাগ কেটেছে। ট্রেনে করে ঢাকা থেকে রানী গিয়েছিলেন গাজীপুরের বৈরাগীরচালা গ্রামে। সেখানে তিনি ঢেঁকিতে ধান ভানা, মুড়ি ভাজা ও মুরগি পালনসহ মানুষের জীবনধারা উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা ঢাকায় এসে শান্তির বাণী শুনিয়ে গেছেন। চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই ঢাকা নগরী আমাদের গর্বের প্রিয় নগরী।
No comments:
Post a Comment