প্রিয় এই ঢাকা শহর
র বি উ ল হু সা ই ন
স্থাপত্য শিল্পের প্রধান গুণ হচ্ছে পরিবেশকে সুন্দর আর ব্যবহারযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যমূলক প্রয়াস নির্ধারণ। এজন্য একজন স্থপতি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। যেখানে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নির্মিতব্য একটি বা বহু ভবন যে উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হচ্ছে তা যেন সফল এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়, ভেতরে এবং বাইরে, সেই রকমভাবে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেবাদান করাই তার লক্ষ্য। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের পরিবেশকে আরও উন্নত করাও তার অন্যতম প্রধান কর্তব্য। তার কাজের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান পরিবেশকে গুণগত পরিবর্তন করার বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ পায়। এই তুলনায় পরিকল্পনাবিদদের কাজ আরও ব্যাপক; যেহেতু তারা জনপদে নগরায়ন সৃষ্টিতে মহাপরিকল্পনা করেন। যে কোনো পরিকল্পনায় স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী প্রমুখের পৃথক ও নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গেরও। ওই পরিকল্পিত ভবন, শহর, শহরতলি বা জনপদ সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে উঠছে কিনা, সেটি তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে সরকার এবং সুশীল নাগরিকদের অংশগ্রহণ করা একান্তভাবেই প্রয়োজন। উন্নত দেশে কাঠামোয় এই ব্যবস্থা যৌথায়ন অর্থাত্ ব্যক্তি ও সরকার, সমভিব্যহারে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি সংস্কার মাধ্যমে হয়ে থাকে। আমাদের ঢাকা শহর রক্তের উচ্চচাপ ব্যাধিগ্রস্ত একজন অসহায় রোগীর করুণ অবস্থায় যে দশা হয়, তার মধ্যে পতিত হয়েছে। সেই প্রায় চারশ’ বছরের পুরনো জনপদ আজ অপরিকল্পিতভাবে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মতো ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে তো হচ্ছেই।
এই ব্রহ্মাণ্ডজগত দু’টি দিক দিয়ে বিবেচনায় ঢাকা শহরের বিষয়ে আসন পার্থক্য নির্দেশ করে। এক. ব্রহ্মাণ্ডজগত্ অদৃশ্য এক কঠোর নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যে ক্রমাগত বিন্যাসিত হচ্ছে গ্রহ-তারা নিয়ে; দুই. বিপুল বিশাল শূন্যতার মধ্যে সেই প্রসারণের জন্য কোনো পরিসরের অভাব নেই, কখনও হবেও না। সেই তুলনায় ঢাকা শহরের ক্রমান্তর বিকল্প কোনো শৃঙ্খলা ও নিয়মহীন এবং এর জায়গারও খুব অভাব। প্রবল জনসংখ্যার চাপ এবং প্রতিটি বিষয়ে অনিয়মই একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগর পরিকল্পনা যেভাবে হয়েছিল যেখানে এক একটি অঞ্চল নিয়ে এক একটি পৃথক ব্যবহারিক কর্মকাণ্ড যেমন আবাসিক, বাণিজ্যিক, বিনোদন, সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তর, জলাভূমি, রাস্তাঘাট, নদী, খাল ইত্যাদির সম্মিলিত সন্নিবেশিত রূপ এখন একটির সঙ্গে অন্যটি মিলে-মিশে জগাখিচুড়ি পর্যায়ের অবস্থানে উপনীত হয়েছে। তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় লোপ পেয়েছে বহমান অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপের দরুন। রাস্তায় নামলে যানজট, একই রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের বিভিন্ন গতি, এর ওপর নিরাপত্তহীনতা, সন্ত্রাস আর ছিনতাইকারীদের অত্যাচার ও অপমান। কোনো কোনো অঞ্চলে একই সঙ্গে আবাসিক-প্রাতিষ্ঠানিক; অর্থাত্ স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, হোটেল, দোকানপাট একই লাইনে বিরাজ করছে। উন্মুক্ত সবুজ মাঠ বা জলাভূমি এই শহর থেকে প্রায় উধাও। যে খাল-বিল ছিল সব ভরাট করে বহুতলবিশিষ্ট বাণিজ্যিক আর আবাসিক ভবন তৈরি হচ্ছে এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তপক্ষ প্রদত্ত নির্দিষ্ট আইন মান্য করার কোনো সদিচ্ছা নেই। যে যার মতো করে চলেছে। কর্তৃপক্ষের প্রচ্ছন্ন দুর্নীতির মাধমে এসব বাস্তবায়িত হয় এবং এখনও হয়ে আসছে।
প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রত্যক্ষ প্রভাব যেন ঢাকা শহরকে আরও মর্মান্তিক শহরে পর্যবসিত করে তুলেছে। আইন যে নেই তা নয়, প্রতিটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও সুচারুভাবে আইন প্রণীত হয়েছে, যদিও তা ছিল ব্রিটিশ আমলের উপযোগী। কিন্তু আইন তখনই আইন যখন তা মান্য করা হয়। আমাদের দেশে আইন মান্য করার মানসিকতা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে, ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এক ধরনের মাত্স্যন্যায় অবস্থার মধ্যে সবাই দিনাতিপাত করছে। রাজউকের সঠিক নিয়ম অনুযায়ী ঢাকা শহরে নির্মিতব্য প্রতিটি দালান-কোঠার নকশা করা হয় এবং সেইমত জমা দিয়ে নির্মাণ করার অনুমতি ও অনুমোদন পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে নির্মাণ করার সময় মালিক নিজেই নিজের জমি চুরি করে নিয়মভঙ্গ করেন এবং চারদিকে প্রায় সীমানা পর্যন্ত ভবনটিকে প্রসারিত করেন। এই অনিয়ম-পদ্ধতি প্রায় সব মালিক অনুসরণ করে নিজেদের সুস্পষ্টভাবে অপরাধী হিসেবে সৃষ্টি করছেন এবং এতে বাধা দেয়ার কেউ নেই। সরকার বা সুশীল সমাজে এমন কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি যার ফলে তারা বলবেন যে, ভাই এভাবে এটি সম্পাদন করা ঠিক হয়নি। এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কার্যকৌশল কোথাও দেখা যায় না। সাধারণত সামনের রাস্তা বিশ ফুট চওড়া হলে সীমানা থেকে পাঁচ ফুট ছেড়ে ভবন তৈরি করতে হয়। তখন ভবনের উচ্চতা হবে পঞ্চাশ ফুট অর্থাত্ পাঁচতলা। এখন দেখা যায়, অনেকেই এই আইন মানেন না। তারা একেবারে জমির সীমানা পর্যন্ত বারান্দসহ ভবন নিয়ে আসেন। স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এটা নিয়ম ভঙ্গ করে তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের প্রতিবাদ, বাধা, আপত্তি, কেউ করে না এবং করার কেউ নেই। আর যদি করা হয়, তাহলে দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিপদে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। তাই সরকার বা পাবলিক কোনো দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। যেন সেই নাগরিকবোধটিই লোপ পেয়েছে আমাদের মাঝ থেকে। সাধারণত সামনের রাস্তা পঞ্চাশ ফুট চওড়া হলে ভবনের উচ্চতা একশ’ দশ ফুট, অর্থাত্ এগারোতলা করা যায়। কিন্তু ঢাকা শহরের অলিগলিতে অবস্থিত পনের-বিশ ফুট চওড়া রাস্তার পাশেই বহুতল দশ-বারো তলা উচ্চতাবিশিষ্ট ভবন গড়ে উঠছে। শোনা যায়, রাজউকের একশ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মীর সাহায্যে এসব দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করার কর্মযজ্ঞ কাগজে-কলমে ঠিক করা হয়। তারা সামনের বিশ ফুট চওড়া রাস্তা নকশায় পঞ্চাশ ফুট দেখিয়ে আইনগত নীতিমালা অতিক্রম করে। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট স্থপতি এই ষড়যন্ত্রের কথা কিছু জানতে পারেন না। এখন মূল পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যদি এমন অনিয়ম এবং দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে সেখানে আর কোনো আশা থাকে না। আশার কথা, এখন উপরিউক্ত নিয়ম আর অনুসৃত হচ্ছে না, তার দলে ঋঅজ পদ্ধতি এই ২০০৮ সালে চালু হয়েছে অর্থাত্ ফ্লোর-ঋষড়ড়ত্ অত্বধ জধঃরড় একটি প্লটে নির্ধারিত নিয়মানুযায়ী ভবন উঁচু করা যাবে, তবে সেই অনুপাতে চারদিকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে এবং স্থপতি-প্রকৌশলী-মালিক সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। এর অন্যথা হলে শাস্তি পেতে হবে। নিয়মে হয়তো কাজ হবে এই আশা করা যায়।
ঢাকা শহর দ্রুতগতিতে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহরে পরিণত হতে যাচ্ছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, শুধু জনসংখ্যা দিয়েই শহরের বিরাটত্ব বা বিশালত্ব দাবি করার মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত শহরে জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে সেবা অর্থাত্ যোগাযোগের রাস্তা ও বাণিজ্যিক-আবাসিক সুযোগ-সুবিধা, কর্মসংস্থান, বিনোদন, খোলা জায়গা, জলাভূমিসহ বিদ্যুত্, গ্যাস, জলের সুচারু আর অবাধ সরবরাহের সুচিন্তিত ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করে বসবাসোপযোগী করে তোলা হয়। সেই তুলনায় ঢাকা শহরে করা হয় না কখনও; অথচ হু হু করে দালানকোঠার সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জল, বিদ্যুত্, গ্যাসসহ রাস্তাঘাটের সুবিধা যা আছে, তাই। এর কোনো পরিবর্তন নেই। অতএব আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহর দৈব-দুর্বিপাকের শহর হিসেবে দিন দিন পরিণত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই অবস্থা রোধ, নিরসন এবং সুচিন্তিভাবে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে এ শহরের পরিণতি খুবই খারাপ হবে—একথা হলফ করে বলা যায়। আর এর মধ্যে যদি শতাব্দীর ধাক্কা নামক আসন্ন ভূমিকম্প এখানে মারাত্মকভাবে আঘাত করে, তাহলে কী যে হবে সে কথা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।
ঢাকা শহরের মূল আকর্ষণ ছিল নদী, পুকুর, খাল ও জলাশয়। আমাদের শহরে পাহাড় নেই। এছাড়া যে কোনো শহর মূল তিনটি অপরিহার্য বস্তু বা উপাদান নিয়ে গঠিত হয়। মাটি, বৃক্ষরাজি এবং জলাশয়। প্রকৃতি ও নিসর্গের মূল আকর্ষণীয় বিষয়বস্তুই এই ত্রি-গুণ বস্তুর সমন্বিত বিন্যাস। নগর পরিকল্পনায় তাই সব সময় যতদূর সম্ভব এই তিনটি প্রকৃতির দানকে অক্ষুণ্ন রেখে চিন্তা-ভাবনা করা হয়। ঢাকা শহরকে প্রকৃতি যেভাবে গড়তে চেয়েছিল, মানুষের উচিত ছিল তাকে অনুসরণ করা। কিন্তু তা না করে আমরা বর্বর, অশিক্ষিত প্রাণধারণকারী মনুষ্যপদবাচ্য প্রাণী ইচ্ছেমত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য সেই সুবিন্যাসকে অবিন্যাসিত করে ভাবীকালের ভাবী প্রজন্মের কাছে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছি। ঢাকা শহরে যে প্রাকৃতিক খাল-বিল ছিল, তা ভরাট করে শহর সম্প্রসারণ করেছি। ঢাকা শহরের যে বন্যা-পরবর্তী নাব্যতা ছিল, তার ভারসাম্য নষ্ট করেছি। ঢাকা শহরের যে অপরূপ সৌন্দর্য ছিল তাকে আমরা হত্যা করেছি। ঢাকা শহর বা যে কোনো শহরে যে হারে উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তর থাকার কথা ছিল, তা পূর্ণ না করে আমরা তাত্ক্ষণিক লাভজনক কর্মক্রিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় নেমে গেছি। বর্তমানে তাত্ক্ষণিক স্বার্থ হাসিল যে ভবিষ্যতের জন্য স্থায়ী ক্ষতিকারক হয়ে পড়ছে—সে কথা আমরা ঘুণাক্ষরেও চিন্তার মধ্যে আনছি না। এজন্য আমরা অসভ্যভাবে বুড়িগঙ্গার বুকেও হাত দিচ্ছি। এটাকে ড্রেজিং করে এর নাব্যতা, গভীরতা ও জল দূষণ মুক্তি এবং নিরসনের ব্যবস্থা এখনই করা দরকার। তা না করে উল্টো এর জলাভূমি ভরাট করে নদী চুরির মতো জঘন্য কাজ করে পরিবেশ হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত হচ্ছি। বিদ্যমান ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারের সমালোচনা করা যদি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অপরাধ হয়, তাহলে তার চেয়েও বড় অপরাধ এই সামগ্রিক পরিবেশ দূষণক্রিয়া এবং সরকার যদি এই অপরাধকে কঠোরভাবে দমন না করে তাহলে কালের বিচারে এরাও অপরাধী।
ঢাকা শহরকে ঘিরে যে ৪৮টি খাল ও ৬টি নদী বিদ্যমান ছিল, এদের কোনোটার কিছু আছে, কোনোটার কিছু নেই। সেগুলো পুনর্খনন করে নাব্য করা দরকার। ঢাকা শহরে ইদানীং বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পাশাপাশি বহুতল আবাসিক ভবন নির্মিত হচ্ছে। আবাসিক ভবনের ভীষণ চাহিদা পূরণের বিষয়ে সেগুলো বলা যায় যথেষ্ট অবদান রাখছে। কিন্তু তা অন্যদিক দিয়ে মানুষের চিন্তা-চেতনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে। এ কারণে উন্নত দেশে বহুতল দালানে বসবাস করা মানুষজন পরিত্যাগ করতে শুরু করেছে। হয়তো নববিবাহিত দম্পতিদের কিছুকালের জন্য অথবা অতিথি ভবন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এগুলো আদর্শ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সবাই চায় মাটির কাছাকাছি খোলা জায়গায় আলো-হাওয়ায় জীবন কাটাতে। বিশেষ করে মা-বাবার সন্তান পালনে বহুতল দালান খুবই অনুপযোগী; যেখানে শিশুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফার্মের মুরগির মতো তাদের জীবন-মনের অবচেতনায় কৃত্রিম আবহাওয়ায় অমানবিক-অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে ওইসব শিশু প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রযত্ন এবং প্রভাবে মানুষ না হতে পেরে অন্যভাবে বিকশিত হয়। তারা একাকিত্ব ও বিরূপ পরিবেশে মন-মানসিকতায় অস্বাভাবিক আচরণে জীবনবিমুখ হয়ে পড়ে। বহুতল দালানের কক্ষাবাসে বাস করে তাদের সবকিছুই বর্গ, আয়ত বা বৃত্তে বন্দি হয়ে যায়। এ সম্বন্ধে কবি জেরাল্ড রাফটারি লিখেছেন—
A filing cabinet of human lives,
Where people swarm like bees in tunneled hives
Each to his own cell in the towered comb
Identical and cramped we call it home.
আবার আলফোসানিয়া স্টরনি আর এক কবিতায় বলেছেন—
Houses in a row, houses in a row,
Houses in a row
Squares, squares, sqaures
Houses in a row
People already have square souls,
Ideas in a row.
And angles on their backs
I myself shed a tear yesterday
Which was good heavens-square.
তবে ভালোভাবে বসবাস করার জন্য মহত্ শহরের উত্কর্ষে মহান মানুষজনের দরকার। সেই শহরই সুন্দর যে শহরে সুন্দর মনের মানুষ বাস করে।
কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান তাই বলেছেন—
The greatest city is that which has the greatest men and women. If it be a few rugged hut, it is still the greatest city.
তাই সব কথার শেষ কথা, রবি ঠাকুরের গানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলা যায়, তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ (মানুষ) চাই।
ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের আগ্রাসী মনোভাবের জন্য এখানে কোনো উন্মুক্ত প্রান্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। একটুখানি ফাঁকা পেলেই সেখানে নির্মিত হয় বড় বড় দালানকোঠা। জোনিং বা সুনির্দিষ্টভাবে একেকটি অঞ্চলের ব্যবহারিক সীমারেখা অন্তর্গত কর্মকাণ্ড ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং বেসরকারি পর্যায়ে। যেমন রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত স্থান, সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রীদের আবাসিক এলাকা, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এবং বাসভবন, সেনানিবাস ইত্যাদি সব মূল শহরের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিরাজ করছে। ফলে ওইসব রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাষ্ট্রপতির একই রাস্তা দিয়ে বিশেষ প্রতিরক্ষায় চলাফেরা জনগণের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত এক যান-জমাটের সম্মুখীন করে তোলে এবং এতে সাধারণ মানুষের প্রভূত ক্ষতি হয়। তাই জোহানেসবার্গের মতো রাজধানী দু’ভাবে পৃথক করে একটি বাণিজ্যিক আর একটি প্রশাসনিক কার্যপ্রণালী পরিচালন করার জন্য বিশেষায়িত করা এখনই প্রয়োজন। নদী, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র সৈকত, উন্মুক্ত প্রান্তর, হ্রদ, খাল-বিল—যা এই দেশের প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকরখনি ও পরিবেশ সহায়তাকারী একমাত্র উপাদান, সেগুলোকে মানুষের থাবা থেকে চিরকালের জন্য রক্ষা করার অভিপ্রায়ে জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা এখনই প্রয়োজন। এসবের বিরুদ্ধে কেউ কোনো আচরণ করলে তা বড় একটি দেশনাশকতামূলক অপরাধ হিসেবে ধরা হবে।
ঢাকা শহরের ওপর অপ্রতিরোধ্য যাবতীয় বিষয়ের চাপ কমানোর জন্য অচিরেই বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা এখনই প্রয়োজন। দরকার হলে দেশকে চার-পাঁচটি বিভাগে ভাগ করে তার অধীনে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন, বিচার ও বাণিজ্য-কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ করার দরকার হয়ে পড়েছে। ভয়াবহ আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য ঢাকা শহরকে মেট্রোপলিটন শহর ঘোষণা দিয়ে পুলিশ, বিদ্যুত্, জল, গ্যাস, পয়ঃপ্রণালী, আবর্জনা সম্পসারণ সব জনপ্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত করার এখনই প্রয়োজন। ঢাকা শহরের বিপুল আবর্জনারাশিকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে অন্যান্য শহরের মতো উপজাত সার, বিশুদ্ধ জল বা নির্মাণ সামগ্রী উপকরণ প্রস্তুত করার শিল্পায়ন ব্যবস্থা একান্তভাবে বাস্তবায়িত করা এখনই প্রয়োজন। পুলিশ বিভাগকে পুনর্বিন্যাসিত করে এদের প্রতিটি জেলা-উপজেলা শহরের জনপ্রতিনিধির অধীনে ন্যস্ত করার দরকার, যারা কম্যুনিটি পুলিশ বা জনগণের পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত হবে। বিচার বিভাগকে পৃথক করে তদুপরি বিচারের আগেকার মতো পঞ্চায়েত পদ্ধতি বা ঢাকা শহরের মহল্লার সর্দার দ্বারা জনপ্রতিনিধিমূলক বিচার-ব্যবস্থার নতুনরূপে পুনঃপ্রচলন প্রয়োজন। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের সংখ্যা আরও প্রচুর পরিমাণে বাড়াতে হবে, বুড়িগঙ্গার দুই পাড় জাতীয় উদ্যানে পরিণত করতে হবে। এজন্য বাণিজ্যিক লঞ্চ-ঘাট আরও দক্ষিণে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া এখনই প্রয়োজন। এই সঙ্গে সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে। যানবাহন ও যাতায়াতের ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ঢাকা শহরে বৃহত্তর সীমারেখা দিয়ে ভূ-উপরি রিং রোডের সঙ্গে বিদ্যুত্ ট্রেন চালু করাসহ ভূ-তল ট্রেনের ব্যবস্থা করা এখনই প্রয়োজন। ঢাকা ও অন্যান্য শহরের নিমাণ কার্য নিয়ন্ত্রণ-সুরক্ষা করার জন্য দেশে স্থপতি-আইন প্রবর্তন এখনই প্রয়োজন; যেখানে কর্মকর্তা, গ্রাহক ও স্থপতির জবাবদিহিতাসহ তাদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থাও থাকবে। নাগরিক অধিকার বলবত্ করাসহ জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ঢাকা বা অন্যান্য শহরের পরিকল্পনায় অন্যতম বিষয় ও অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হওয়া এখনই প্রয়োজন। তা না হলে এই প্রিয় ঢাকা শহর দুঃখ ও হতাশার অন্ধকারে চিরকাল ঢাকা পড়ে থাকবে।
এই ব্রহ্মাণ্ডজগত দু’টি দিক দিয়ে বিবেচনায় ঢাকা শহরের বিষয়ে আসন পার্থক্য নির্দেশ করে। এক. ব্রহ্মাণ্ডজগত্ অদৃশ্য এক কঠোর নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যে ক্রমাগত বিন্যাসিত হচ্ছে গ্রহ-তারা নিয়ে; দুই. বিপুল বিশাল শূন্যতার মধ্যে সেই প্রসারণের জন্য কোনো পরিসরের অভাব নেই, কখনও হবেও না। সেই তুলনায় ঢাকা শহরের ক্রমান্তর বিকল্প কোনো শৃঙ্খলা ও নিয়মহীন এবং এর জায়গারও খুব অভাব। প্রবল জনসংখ্যার চাপ এবং প্রতিটি বিষয়ে অনিয়মই একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগর পরিকল্পনা যেভাবে হয়েছিল যেখানে এক একটি অঞ্চল নিয়ে এক একটি পৃথক ব্যবহারিক কর্মকাণ্ড যেমন আবাসিক, বাণিজ্যিক, বিনোদন, সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তর, জলাভূমি, রাস্তাঘাট, নদী, খাল ইত্যাদির সম্মিলিত সন্নিবেশিত রূপ এখন একটির সঙ্গে অন্যটি মিলে-মিশে জগাখিচুড়ি পর্যায়ের অবস্থানে উপনীত হয়েছে। তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় লোপ পেয়েছে বহমান অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপের দরুন। রাস্তায় নামলে যানজট, একই রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের বিভিন্ন গতি, এর ওপর নিরাপত্তহীনতা, সন্ত্রাস আর ছিনতাইকারীদের অত্যাচার ও অপমান। কোনো কোনো অঞ্চলে একই সঙ্গে আবাসিক-প্রাতিষ্ঠানিক; অর্থাত্ স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, হোটেল, দোকানপাট একই লাইনে বিরাজ করছে। উন্মুক্ত সবুজ মাঠ বা জলাভূমি এই শহর থেকে প্রায় উধাও। যে খাল-বিল ছিল সব ভরাট করে বহুতলবিশিষ্ট বাণিজ্যিক আর আবাসিক ভবন তৈরি হচ্ছে এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তপক্ষ প্রদত্ত নির্দিষ্ট আইন মান্য করার কোনো সদিচ্ছা নেই। যে যার মতো করে চলেছে। কর্তৃপক্ষের প্রচ্ছন্ন দুর্নীতির মাধমে এসব বাস্তবায়িত হয় এবং এখনও হয়ে আসছে।
প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রত্যক্ষ প্রভাব যেন ঢাকা শহরকে আরও মর্মান্তিক শহরে পর্যবসিত করে তুলেছে। আইন যে নেই তা নয়, প্রতিটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও সুচারুভাবে আইন প্রণীত হয়েছে, যদিও তা ছিল ব্রিটিশ আমলের উপযোগী। কিন্তু আইন তখনই আইন যখন তা মান্য করা হয়। আমাদের দেশে আইন মান্য করার মানসিকতা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে, ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এক ধরনের মাত্স্যন্যায় অবস্থার মধ্যে সবাই দিনাতিপাত করছে। রাজউকের সঠিক নিয়ম অনুযায়ী ঢাকা শহরে নির্মিতব্য প্রতিটি দালান-কোঠার নকশা করা হয় এবং সেইমত জমা দিয়ে নির্মাণ করার অনুমতি ও অনুমোদন পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে নির্মাণ করার সময় মালিক নিজেই নিজের জমি চুরি করে নিয়মভঙ্গ করেন এবং চারদিকে প্রায় সীমানা পর্যন্ত ভবনটিকে প্রসারিত করেন। এই অনিয়ম-পদ্ধতি প্রায় সব মালিক অনুসরণ করে নিজেদের সুস্পষ্টভাবে অপরাধী হিসেবে সৃষ্টি করছেন এবং এতে বাধা দেয়ার কেউ নেই। সরকার বা সুশীল সমাজে এমন কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি যার ফলে তারা বলবেন যে, ভাই এভাবে এটি সম্পাদন করা ঠিক হয়নি। এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কার্যকৌশল কোথাও দেখা যায় না। সাধারণত সামনের রাস্তা বিশ ফুট চওড়া হলে সীমানা থেকে পাঁচ ফুট ছেড়ে ভবন তৈরি করতে হয়। তখন ভবনের উচ্চতা হবে পঞ্চাশ ফুট অর্থাত্ পাঁচতলা। এখন দেখা যায়, অনেকেই এই আইন মানেন না। তারা একেবারে জমির সীমানা পর্যন্ত বারান্দসহ ভবন নিয়ে আসেন। স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এটা নিয়ম ভঙ্গ করে তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের প্রতিবাদ, বাধা, আপত্তি, কেউ করে না এবং করার কেউ নেই। আর যদি করা হয়, তাহলে দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিপদে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। তাই সরকার বা পাবলিক কোনো দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। যেন সেই নাগরিকবোধটিই লোপ পেয়েছে আমাদের মাঝ থেকে। সাধারণত সামনের রাস্তা পঞ্চাশ ফুট চওড়া হলে ভবনের উচ্চতা একশ’ দশ ফুট, অর্থাত্ এগারোতলা করা যায়। কিন্তু ঢাকা শহরের অলিগলিতে অবস্থিত পনের-বিশ ফুট চওড়া রাস্তার পাশেই বহুতল দশ-বারো তলা উচ্চতাবিশিষ্ট ভবন গড়ে উঠছে। শোনা যায়, রাজউকের একশ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মীর সাহায্যে এসব দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করার কর্মযজ্ঞ কাগজে-কলমে ঠিক করা হয়। তারা সামনের বিশ ফুট চওড়া রাস্তা নকশায় পঞ্চাশ ফুট দেখিয়ে আইনগত নীতিমালা অতিক্রম করে। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট স্থপতি এই ষড়যন্ত্রের কথা কিছু জানতে পারেন না। এখন মূল পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যদি এমন অনিয়ম এবং দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে সেখানে আর কোনো আশা থাকে না। আশার কথা, এখন উপরিউক্ত নিয়ম আর অনুসৃত হচ্ছে না, তার দলে ঋঅজ পদ্ধতি এই ২০০৮ সালে চালু হয়েছে অর্থাত্ ফ্লোর-ঋষড়ড়ত্ অত্বধ জধঃরড় একটি প্লটে নির্ধারিত নিয়মানুযায়ী ভবন উঁচু করা যাবে, তবে সেই অনুপাতে চারদিকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে এবং স্থপতি-প্রকৌশলী-মালিক সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। এর অন্যথা হলে শাস্তি পেতে হবে। নিয়মে হয়তো কাজ হবে এই আশা করা যায়।
ঢাকা শহর দ্রুতগতিতে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহরে পরিণত হতে যাচ্ছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, শুধু জনসংখ্যা দিয়েই শহরের বিরাটত্ব বা বিশালত্ব দাবি করার মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত শহরে জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে সেবা অর্থাত্ যোগাযোগের রাস্তা ও বাণিজ্যিক-আবাসিক সুযোগ-সুবিধা, কর্মসংস্থান, বিনোদন, খোলা জায়গা, জলাভূমিসহ বিদ্যুত্, গ্যাস, জলের সুচারু আর অবাধ সরবরাহের সুচিন্তিত ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করে বসবাসোপযোগী করে তোলা হয়। সেই তুলনায় ঢাকা শহরে করা হয় না কখনও; অথচ হু হু করে দালানকোঠার সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জল, বিদ্যুত্, গ্যাসসহ রাস্তাঘাটের সুবিধা যা আছে, তাই। এর কোনো পরিবর্তন নেই। অতএব আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহর দৈব-দুর্বিপাকের শহর হিসেবে দিন দিন পরিণত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই অবস্থা রোধ, নিরসন এবং সুচিন্তিভাবে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে এ শহরের পরিণতি খুবই খারাপ হবে—একথা হলফ করে বলা যায়। আর এর মধ্যে যদি শতাব্দীর ধাক্কা নামক আসন্ন ভূমিকম্প এখানে মারাত্মকভাবে আঘাত করে, তাহলে কী যে হবে সে কথা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।
ঢাকা শহরের মূল আকর্ষণ ছিল নদী, পুকুর, খাল ও জলাশয়। আমাদের শহরে পাহাড় নেই। এছাড়া যে কোনো শহর মূল তিনটি অপরিহার্য বস্তু বা উপাদান নিয়ে গঠিত হয়। মাটি, বৃক্ষরাজি এবং জলাশয়। প্রকৃতি ও নিসর্গের মূল আকর্ষণীয় বিষয়বস্তুই এই ত্রি-গুণ বস্তুর সমন্বিত বিন্যাস। নগর পরিকল্পনায় তাই সব সময় যতদূর সম্ভব এই তিনটি প্রকৃতির দানকে অক্ষুণ্ন রেখে চিন্তা-ভাবনা করা হয়। ঢাকা শহরকে প্রকৃতি যেভাবে গড়তে চেয়েছিল, মানুষের উচিত ছিল তাকে অনুসরণ করা। কিন্তু তা না করে আমরা বর্বর, অশিক্ষিত প্রাণধারণকারী মনুষ্যপদবাচ্য প্রাণী ইচ্ছেমত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য সেই সুবিন্যাসকে অবিন্যাসিত করে ভাবীকালের ভাবী প্রজন্মের কাছে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছি। ঢাকা শহরে যে প্রাকৃতিক খাল-বিল ছিল, তা ভরাট করে শহর সম্প্রসারণ করেছি। ঢাকা শহরের যে বন্যা-পরবর্তী নাব্যতা ছিল, তার ভারসাম্য নষ্ট করেছি। ঢাকা শহরের যে অপরূপ সৌন্দর্য ছিল তাকে আমরা হত্যা করেছি। ঢাকা শহর বা যে কোনো শহরে যে হারে উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তর থাকার কথা ছিল, তা পূর্ণ না করে আমরা তাত্ক্ষণিক লাভজনক কর্মক্রিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় নেমে গেছি। বর্তমানে তাত্ক্ষণিক স্বার্থ হাসিল যে ভবিষ্যতের জন্য স্থায়ী ক্ষতিকারক হয়ে পড়ছে—সে কথা আমরা ঘুণাক্ষরেও চিন্তার মধ্যে আনছি না। এজন্য আমরা অসভ্যভাবে বুড়িগঙ্গার বুকেও হাত দিচ্ছি। এটাকে ড্রেজিং করে এর নাব্যতা, গভীরতা ও জল দূষণ মুক্তি এবং নিরসনের ব্যবস্থা এখনই করা দরকার। তা না করে উল্টো এর জলাভূমি ভরাট করে নদী চুরির মতো জঘন্য কাজ করে পরিবেশ হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত হচ্ছি। বিদ্যমান ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারের সমালোচনা করা যদি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অপরাধ হয়, তাহলে তার চেয়েও বড় অপরাধ এই সামগ্রিক পরিবেশ দূষণক্রিয়া এবং সরকার যদি এই অপরাধকে কঠোরভাবে দমন না করে তাহলে কালের বিচারে এরাও অপরাধী।
ঢাকা শহরকে ঘিরে যে ৪৮টি খাল ও ৬টি নদী বিদ্যমান ছিল, এদের কোনোটার কিছু আছে, কোনোটার কিছু নেই। সেগুলো পুনর্খনন করে নাব্য করা দরকার। ঢাকা শহরে ইদানীং বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পাশাপাশি বহুতল আবাসিক ভবন নির্মিত হচ্ছে। আবাসিক ভবনের ভীষণ চাহিদা পূরণের বিষয়ে সেগুলো বলা যায় যথেষ্ট অবদান রাখছে। কিন্তু তা অন্যদিক দিয়ে মানুষের চিন্তা-চেতনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে। এ কারণে উন্নত দেশে বহুতল দালানে বসবাস করা মানুষজন পরিত্যাগ করতে শুরু করেছে। হয়তো নববিবাহিত দম্পতিদের কিছুকালের জন্য অথবা অতিথি ভবন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এগুলো আদর্শ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সবাই চায় মাটির কাছাকাছি খোলা জায়গায় আলো-হাওয়ায় জীবন কাটাতে। বিশেষ করে মা-বাবার সন্তান পালনে বহুতল দালান খুবই অনুপযোগী; যেখানে শিশুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফার্মের মুরগির মতো তাদের জীবন-মনের অবচেতনায় কৃত্রিম আবহাওয়ায় অমানবিক-অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে ওইসব শিশু প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রযত্ন এবং প্রভাবে মানুষ না হতে পেরে অন্যভাবে বিকশিত হয়। তারা একাকিত্ব ও বিরূপ পরিবেশে মন-মানসিকতায় অস্বাভাবিক আচরণে জীবনবিমুখ হয়ে পড়ে। বহুতল দালানের কক্ষাবাসে বাস করে তাদের সবকিছুই বর্গ, আয়ত বা বৃত্তে বন্দি হয়ে যায়। এ সম্বন্ধে কবি জেরাল্ড রাফটারি লিখেছেন—
A filing cabinet of human lives,
Where people swarm like bees in tunneled hives
Each to his own cell in the towered comb
Identical and cramped we call it home.
আবার আলফোসানিয়া স্টরনি আর এক কবিতায় বলেছেন—
Houses in a row, houses in a row,
Houses in a row
Squares, squares, sqaures
Houses in a row
People already have square souls,
Ideas in a row.
And angles on their backs
I myself shed a tear yesterday
Which was good heavens-square.
তবে ভালোভাবে বসবাস করার জন্য মহত্ শহরের উত্কর্ষে মহান মানুষজনের দরকার। সেই শহরই সুন্দর যে শহরে সুন্দর মনের মানুষ বাস করে।
কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান তাই বলেছেন—
The greatest city is that which has the greatest men and women. If it be a few rugged hut, it is still the greatest city.
তাই সব কথার শেষ কথা, রবি ঠাকুরের গানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলা যায়, তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ (মানুষ) চাই।
ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের আগ্রাসী মনোভাবের জন্য এখানে কোনো উন্মুক্ত প্রান্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। একটুখানি ফাঁকা পেলেই সেখানে নির্মিত হয় বড় বড় দালানকোঠা। জোনিং বা সুনির্দিষ্টভাবে একেকটি অঞ্চলের ব্যবহারিক সীমারেখা অন্তর্গত কর্মকাণ্ড ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং বেসরকারি পর্যায়ে। যেমন রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত স্থান, সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রীদের আবাসিক এলাকা, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এবং বাসভবন, সেনানিবাস ইত্যাদি সব মূল শহরের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিরাজ করছে। ফলে ওইসব রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাষ্ট্রপতির একই রাস্তা দিয়ে বিশেষ প্রতিরক্ষায় চলাফেরা জনগণের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত এক যান-জমাটের সম্মুখীন করে তোলে এবং এতে সাধারণ মানুষের প্রভূত ক্ষতি হয়। তাই জোহানেসবার্গের মতো রাজধানী দু’ভাবে পৃথক করে একটি বাণিজ্যিক আর একটি প্রশাসনিক কার্যপ্রণালী পরিচালন করার জন্য বিশেষায়িত করা এখনই প্রয়োজন। নদী, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র সৈকত, উন্মুক্ত প্রান্তর, হ্রদ, খাল-বিল—যা এই দেশের প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকরখনি ও পরিবেশ সহায়তাকারী একমাত্র উপাদান, সেগুলোকে মানুষের থাবা থেকে চিরকালের জন্য রক্ষা করার অভিপ্রায়ে জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা এখনই প্রয়োজন। এসবের বিরুদ্ধে কেউ কোনো আচরণ করলে তা বড় একটি দেশনাশকতামূলক অপরাধ হিসেবে ধরা হবে।
ঢাকা শহরের ওপর অপ্রতিরোধ্য যাবতীয় বিষয়ের চাপ কমানোর জন্য অচিরেই বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা এখনই প্রয়োজন। দরকার হলে দেশকে চার-পাঁচটি বিভাগে ভাগ করে তার অধীনে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন, বিচার ও বাণিজ্য-কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ করার দরকার হয়ে পড়েছে। ভয়াবহ আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য ঢাকা শহরকে মেট্রোপলিটন শহর ঘোষণা দিয়ে পুলিশ, বিদ্যুত্, জল, গ্যাস, পয়ঃপ্রণালী, আবর্জনা সম্পসারণ সব জনপ্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত করার এখনই প্রয়োজন। ঢাকা শহরের বিপুল আবর্জনারাশিকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে অন্যান্য শহরের মতো উপজাত সার, বিশুদ্ধ জল বা নির্মাণ সামগ্রী উপকরণ প্রস্তুত করার শিল্পায়ন ব্যবস্থা একান্তভাবে বাস্তবায়িত করা এখনই প্রয়োজন। পুলিশ বিভাগকে পুনর্বিন্যাসিত করে এদের প্রতিটি জেলা-উপজেলা শহরের জনপ্রতিনিধির অধীনে ন্যস্ত করার দরকার, যারা কম্যুনিটি পুলিশ বা জনগণের পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত হবে। বিচার বিভাগকে পৃথক করে তদুপরি বিচারের আগেকার মতো পঞ্চায়েত পদ্ধতি বা ঢাকা শহরের মহল্লার সর্দার দ্বারা জনপ্রতিনিধিমূলক বিচার-ব্যবস্থার নতুনরূপে পুনঃপ্রচলন প্রয়োজন। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের সংখ্যা আরও প্রচুর পরিমাণে বাড়াতে হবে, বুড়িগঙ্গার দুই পাড় জাতীয় উদ্যানে পরিণত করতে হবে। এজন্য বাণিজ্যিক লঞ্চ-ঘাট আরও দক্ষিণে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া এখনই প্রয়োজন। এই সঙ্গে সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে। যানবাহন ও যাতায়াতের ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ঢাকা শহরে বৃহত্তর সীমারেখা দিয়ে ভূ-উপরি রিং রোডের সঙ্গে বিদ্যুত্ ট্রেন চালু করাসহ ভূ-তল ট্রেনের ব্যবস্থা করা এখনই প্রয়োজন। ঢাকা ও অন্যান্য শহরের নিমাণ কার্য নিয়ন্ত্রণ-সুরক্ষা করার জন্য দেশে স্থপতি-আইন প্রবর্তন এখনই প্রয়োজন; যেখানে কর্মকর্তা, গ্রাহক ও স্থপতির জবাবদিহিতাসহ তাদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থাও থাকবে। নাগরিক অধিকার বলবত্ করাসহ জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ঢাকা বা অন্যান্য শহরের পরিকল্পনায় অন্যতম বিষয় ও অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হওয়া এখনই প্রয়োজন। তা না হলে এই প্রিয় ঢাকা শহর দুঃখ ও হতাশার অন্ধকারে চিরকাল ঢাকা পড়ে থাকবে।
No comments:
Post a Comment