ঢাকা বিষয়ক চর্চা ও এশিয়াটিক সোসাইটি
ঐতিহ্যবাহী মহানগরী ঢাকার ইতিহাস চর্চায় অগ্রণী ও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে চলেছে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ। গবেষণা, স্মারক স্তম্ভ নির্মাণ, ঐতিহাসিক ভবনের সংস্কার, প্রদর্শনী, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন এই কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। রাজধানী ঢাকার চারশ’ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে চলছে বিপুল কর্মযজ্ঞ। রমনা এলাকার ৫ নম্বর পুরনো সেক্রেটারিয়েট রোডের (নিমতলী) এশিয়াটিক সোসাইটির কয়েকটি ভবনে নবীন-প্রবীণ গবেষক, শিক্ষক, সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মীরা এই কাজে ব্যাপৃত। এই প্রতিষ্ঠানটিতে যত কাজ হচ্ছে, তার প্রচার খুবই সীমিত। নিভৃত জ্ঞান চর্চা, ইতিহাস পুনরুদ্ধার, চলতি সময়ের প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্যের নবরূপায়ণ ও উপস্থাপনার কাজটি অত্যন্ত দুরূহ। একই সঙ্গে অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুলও। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি, প্রবীণ ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম। ঢাকা বিষয়ক চর্চা, এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার সঙ্গে আলাপ করেছেন আমার দেশ প্রতিনিধি হাসান হাফিজ। অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে আলাপচারিতার বিবরণ—
ঢাকার বিকাশ, বিবর্তন সম্পর্কে ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা মহানগরী চারশ’ বছরের পুরনো। এর ঐতিহ্য অনেক। এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বহুমুখী। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, ৫০-৬০ বছর পরপর এই শহরের নানা বিষয়ে পরিবর্তন ঘটেছে। রূপবদলের প্রক্রিয়ার বিবর্তনে আমরা আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা প্রথম রাজধানী হলো। সেটা ছিল সুবেদার আমল। একশ’ বছর চলল তাতে। তারপর এলো নবাবী শাসনকাল। সুবেদারি শাসন আমলে বাংলার রাজধানী হিসেবে যে ঢাকা গড়ে উঠেছিল, তা ছিল সামরিক শহর। মোগলদের ছিল হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া। এগুলোর লালনপালন, দেখাশোনার জন্য অনেক লোকজন লাগত। সেই শ্রেণীর লোকজন ছাড়া এই শহরে অন্য কেউ বাসিন্দা ছিল না তত্কালে। সামরিক লোকজনও যারা ছিলেন তাদের সবাই বহিরাগত। সে সময়কার ভাষা ছিল ফার্সি। শহরকেন্দ্রিক যে বিকশিত হলো, তাও ছিল ফার্সিভাষাকেন্দ্রিক। খাঁটি মুসলমানী আমল ছিল ওই সময়টা। আনন্দ-উত্সবগুলোও উদযাপিত হতো উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির আদলে।
তারপর রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেল মুর্শিদাবাদে। ওটা নবাবী আমলের শুরু। রাজধানী হিসেবে ঢাকা পরিত্যক্ত হয়ে গেল। মুর্শিদ কুলী খাঁর আমলের কথা বলছি। অষ্টাদশ শতকে ঢাকা পরিণত হলো ক্ষয়িষ্ণু এক মহানগরীতে। শাসন কার্যের অন্যতম অনুষঙ্গ হাতি-ঘোড়া—এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনও চলে গেল মুর্শিদাবাদে। কেউ কেউ বলেন, তখন ঢাকার জনসংখ্যা ৮-৯ লাখ কমে গিয়ে এক লাখে দাঁড়াল। নবাবদের শাসনামলে ভাষাগত পরিবর্তনও ঘটল। ফার্সির বদলে চর্চিত হতে থাকল উর্দু। মুসলমানী সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বেশভূষা রয়ে গেল আগেকার মতোই। এর মধ্যে যোগ হলো নতুন একটি মাত্রা, ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের ঘটনা সেটি। আস্তে আস্তে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ঢাকার উত্থান ঘটতে লাগল। এই উত্থানের সূচনা পর্বটি হচ্ছে ১৯ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। ঢাকায় সমাবেশ ঘটতে লাগল পর্তুগিজ, ফরাসি, আর্মেনীয়, ওলন্দাজ, উত্তর ভারতীয় লোকজনের। প্রায় নিস্তরঙ্গ একটা শহরে আন্তর্জাতিকতার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল সেই সময়টায়। তত্কালে ভাষা হয়ে গেল ইংরেজি, উর্দু থেকে। অর্থাত্ শাসকশ্রেণীর ভাষা হলো ইংরেজি। আর, তলানিতে তো স্থানীয় ভাষা ছিলই। শুধু ঢাকাই নয়, এ অঞ্চলের বহু জায়গায় নির্মিত হলো নীলকুঠি, বাণিজ্য কুঠি। নতুন একটি ধারার প্রবর্তন ঘটল। উদ্ভব হলো নতুন একটি শ্রেণীর। নিম্নবিত্তের শ্রেণী।
বাঙালির আধিপত্যের বিস্তার শুরু হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। বাংলা ভাষা তার জাতীয় রূপ নিয়ে উদ্ভাসিত হতে শুরু করল। ফার্সির রেশ রয়ে গেছে তখনও। উর্দু, হিন্দিও রয়েছে পাশাপাশি। মাল্টিপল কালচারের আস্বাদ মিলত লাগল তত্কালীন ঢাকা শহরে। মোগলরা যখন শাসন করত, তখন বাঙালিরা ছিল অন্ত্যজ শ্রেণীর। ক্রমে ক্রমে বাড়ছিল জনসংখ্যা। যেন এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই কমে আসছিল মুসলমানের সংখ্যা। কারণ মুসলিম সমপ্রদায়ের লোকজন চলে যাচ্ছিলেন মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, লক্ষেষ্টৗ ইত্যাদি অঞ্চলে। আগে ঢাকা শহরে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেটা আর থাকল না। হিন্দুরা এলেন কেরানি হয়ে, সাপ্লায়ার হয়ে। ক্রমে ঢাকা পরিণত হলো হিন্দুপ্রধান শহরে। উনিশ শতকের শেষ দিকে হিন্দুরা হয়ে গেল সংখ্যাগরিষ্ঠ সমপ্রদায়। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত বিভক্ত হয়, তখন ঢাকায় হিন্দুরা ছিল মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ।
এতকাল মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলছিল। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভালো সমপ্রীতি, সখ্য, ঐক্য সবই ছিল। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। ঘটে পরিবর্তন। এটা এক ঐতিহাসিক পালাবদল। ’৪৭ সালের দেশভাগের পর হিন্দুদের এক শ’ জনের মধ্যে নব্বই জনই চলে গেলেন ভারতে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে দেখা যায়, হিন্দুর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশেরও কম।
তারপর বিহারিরা এল এই শহরে। সংস্কৃতির বেহাল অবস্থা। খাদ্যদ্রব্য, ভাষাগত, শিক্ষাগত সমস্যা সঙ্কট দেখা দিল। হিন্দু শিক্ষকরা চলে গেলেন দেশ ছেড়ে। সঙ্কট তৈরি হলো। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঢাকা মহানগরীর দৃশ্য বদল ঘটেছে বারবার। সংস্কৃতি কোনোমতেই স্থিতিশীল থাকতে পারছে না। বিশ্বের অন্য কোনো শহরের ক্ষেত্রে এরকমটি ঘটেনি। এমন বিবর্তনের চিত্র আমরা কোথাও পাইনি। এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা হয়নি।
কেন গবেষণা হলো না বা হচ্ছে না? জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলের মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় পিছিয়ে ছিলেন। পাণ্ডিত্যপূর্ণ স্বভাব, মানসিকতা হঠাত্ করেই তৈরি হয় না। এ জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম সময় লাগে। ওই যে বলছিলাম, দেশভাগের পর বুদ্ধিবৃত্তিক একটা শূন্যতা সৃষ্টি হলো। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান রাতারাতি হাই স্কুলের পর্যায়ে নেমে গলে। শূন্যস্থান পূরণ করা হলো যাদের দিয়ে, তারা এর আগে শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন না বেশির ভাগই।
মেধা মনীষার লালন, বিকাশের জন্য দরকার স্থিতিশীলতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফলে এতকাল ধরে চলে আসা গতিটা ব্যাহত হলো। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে আরও অনুকূল পরিবেশ, পাওয়া, উত্কর্ষ অর্জনের স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু সেটা আর পাওয়া হয়ে উঠল না। গবেষণার ক্ষেত্রে যে উত্কর্ষ ও ব্যাপ্তির প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি। গবেষণার ভুবনে ঈপ্সিত সাফল্য আমরা অর্জন করতে পারলাম না এখনও পর্যন্ত। সেই একটা শূন্যতা রয়েই গেছে। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ এই শূন্যতা পূরণ করতে সর্বশক্তি দিয়ে এগিয়ে এসেছে। তিন বছরব্যাপী একটা প্রকল্পের কাজ চলছে এখন। এই প্রকল্পের পুরো অংশই ঢাকা সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। এর আওতায় মোট ১৯টি বই প্রকাশ করা হবে। এর মধ্যে ১০-১২টি লেখা হয়ে গেছে এরই মধ্যে, বাকিগুলো প্রণয়নের কাজ চলছে। ঢাকার ঐতিহ্য, খাবার-দাবার, ভাষা, ফোকলোর, ইতিহাসসংক্রান্ত বই পুনর্মুদ্রণও এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সেমিনার এরই মধ্যে একটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আরও একটি শিগগিরই আয়োজন করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিষয়ক গবেষণা কেন পর্যাপ্তসংখ্যক হলো না? এর কারণ কী? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নানা কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকেনি। যারা যোগ্য পণ্ডিত, তাদের অনেকেই দেশে থাকেন না। থাকতে চান না। থাকবার অনুকূল পরিবেশেরও অভাব রয়েছে। গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যথেষ্ট ভালো করবার সুযোগ ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে শিক্ষাকে। সরকারের উচিত ছিল এই অরাজকতা, অবক্ষয় কঠোর হাতে দমন করা। এই দেখুন না আমাদের বাংলাপিডিয়া প্রকল্পে ১০ জন সিনিয়র প্রফেসর আগে সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। তাদের ধরে রাখতে পারিনি। উপযুক্ত সম্মানী দিতে পারছি না আমরা। এখন আগের চেয়ে তিন গুণ বেশি টাকা দিয়েও লোক পাচ্ছি না। বাংলাপিডিয়ার দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ চলছে এখন। তরুণদের মধ্যে উত্সাহী গবেষক আমরা খুঁজে খুঁজে বার করছি। আমাদের প্রয়াসে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। আমি সে কারণে হতাশ নই। তরুণদের মধ্যেও জ্ঞানচর্চার আগ্রহ ও কৌতূহল লক্ষ্য করছি। আমি আশাবাদী।
ঢাকার বিকাশ, বিবর্তন সম্পর্কে ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা মহানগরী চারশ’ বছরের পুরনো। এর ঐতিহ্য অনেক। এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বহুমুখী। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, ৫০-৬০ বছর পরপর এই শহরের নানা বিষয়ে পরিবর্তন ঘটেছে। রূপবদলের প্রক্রিয়ার বিবর্তনে আমরা আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা প্রথম রাজধানী হলো। সেটা ছিল সুবেদার আমল। একশ’ বছর চলল তাতে। তারপর এলো নবাবী শাসনকাল। সুবেদারি শাসন আমলে বাংলার রাজধানী হিসেবে যে ঢাকা গড়ে উঠেছিল, তা ছিল সামরিক শহর। মোগলদের ছিল হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া। এগুলোর লালনপালন, দেখাশোনার জন্য অনেক লোকজন লাগত। সেই শ্রেণীর লোকজন ছাড়া এই শহরে অন্য কেউ বাসিন্দা ছিল না তত্কালে। সামরিক লোকজনও যারা ছিলেন তাদের সবাই বহিরাগত। সে সময়কার ভাষা ছিল ফার্সি। শহরকেন্দ্রিক যে বিকশিত হলো, তাও ছিল ফার্সিভাষাকেন্দ্রিক। খাঁটি মুসলমানী আমল ছিল ওই সময়টা। আনন্দ-উত্সবগুলোও উদযাপিত হতো উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির আদলে।
তারপর রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেল মুর্শিদাবাদে। ওটা নবাবী আমলের শুরু। রাজধানী হিসেবে ঢাকা পরিত্যক্ত হয়ে গেল। মুর্শিদ কুলী খাঁর আমলের কথা বলছি। অষ্টাদশ শতকে ঢাকা পরিণত হলো ক্ষয়িষ্ণু এক মহানগরীতে। শাসন কার্যের অন্যতম অনুষঙ্গ হাতি-ঘোড়া—এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনও চলে গেল মুর্শিদাবাদে। কেউ কেউ বলেন, তখন ঢাকার জনসংখ্যা ৮-৯ লাখ কমে গিয়ে এক লাখে দাঁড়াল। নবাবদের শাসনামলে ভাষাগত পরিবর্তনও ঘটল। ফার্সির বদলে চর্চিত হতে থাকল উর্দু। মুসলমানী সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বেশভূষা রয়ে গেল আগেকার মতোই। এর মধ্যে যোগ হলো নতুন একটি মাত্রা, ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের ঘটনা সেটি। আস্তে আস্তে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ঢাকার উত্থান ঘটতে লাগল। এই উত্থানের সূচনা পর্বটি হচ্ছে ১৯ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। ঢাকায় সমাবেশ ঘটতে লাগল পর্তুগিজ, ফরাসি, আর্মেনীয়, ওলন্দাজ, উত্তর ভারতীয় লোকজনের। প্রায় নিস্তরঙ্গ একটা শহরে আন্তর্জাতিকতার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল সেই সময়টায়। তত্কালে ভাষা হয়ে গেল ইংরেজি, উর্দু থেকে। অর্থাত্ শাসকশ্রেণীর ভাষা হলো ইংরেজি। আর, তলানিতে তো স্থানীয় ভাষা ছিলই। শুধু ঢাকাই নয়, এ অঞ্চলের বহু জায়গায় নির্মিত হলো নীলকুঠি, বাণিজ্য কুঠি। নতুন একটি ধারার প্রবর্তন ঘটল। উদ্ভব হলো নতুন একটি শ্রেণীর। নিম্নবিত্তের শ্রেণী।
বাঙালির আধিপত্যের বিস্তার শুরু হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। বাংলা ভাষা তার জাতীয় রূপ নিয়ে উদ্ভাসিত হতে শুরু করল। ফার্সির রেশ রয়ে গেছে তখনও। উর্দু, হিন্দিও রয়েছে পাশাপাশি। মাল্টিপল কালচারের আস্বাদ মিলত লাগল তত্কালীন ঢাকা শহরে। মোগলরা যখন শাসন করত, তখন বাঙালিরা ছিল অন্ত্যজ শ্রেণীর। ক্রমে ক্রমে বাড়ছিল জনসংখ্যা। যেন এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই কমে আসছিল মুসলমানের সংখ্যা। কারণ মুসলিম সমপ্রদায়ের লোকজন চলে যাচ্ছিলেন মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, লক্ষেষ্টৗ ইত্যাদি অঞ্চলে। আগে ঢাকা শহরে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেটা আর থাকল না। হিন্দুরা এলেন কেরানি হয়ে, সাপ্লায়ার হয়ে। ক্রমে ঢাকা পরিণত হলো হিন্দুপ্রধান শহরে। উনিশ শতকের শেষ দিকে হিন্দুরা হয়ে গেল সংখ্যাগরিষ্ঠ সমপ্রদায়। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত বিভক্ত হয়, তখন ঢাকায় হিন্দুরা ছিল মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ।
এতকাল মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলছিল। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভালো সমপ্রীতি, সখ্য, ঐক্য সবই ছিল। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। ঘটে পরিবর্তন। এটা এক ঐতিহাসিক পালাবদল। ’৪৭ সালের দেশভাগের পর হিন্দুদের এক শ’ জনের মধ্যে নব্বই জনই চলে গেলেন ভারতে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে দেখা যায়, হিন্দুর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশেরও কম।
তারপর বিহারিরা এল এই শহরে। সংস্কৃতির বেহাল অবস্থা। খাদ্যদ্রব্য, ভাষাগত, শিক্ষাগত সমস্যা সঙ্কট দেখা দিল। হিন্দু শিক্ষকরা চলে গেলেন দেশ ছেড়ে। সঙ্কট তৈরি হলো। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঢাকা মহানগরীর দৃশ্য বদল ঘটেছে বারবার। সংস্কৃতি কোনোমতেই স্থিতিশীল থাকতে পারছে না। বিশ্বের অন্য কোনো শহরের ক্ষেত্রে এরকমটি ঘটেনি। এমন বিবর্তনের চিত্র আমরা কোথাও পাইনি। এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা হয়নি।
কেন গবেষণা হলো না বা হচ্ছে না? জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলের মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় পিছিয়ে ছিলেন। পাণ্ডিত্যপূর্ণ স্বভাব, মানসিকতা হঠাত্ করেই তৈরি হয় না। এ জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম সময় লাগে। ওই যে বলছিলাম, দেশভাগের পর বুদ্ধিবৃত্তিক একটা শূন্যতা সৃষ্টি হলো। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান রাতারাতি হাই স্কুলের পর্যায়ে নেমে গলে। শূন্যস্থান পূরণ করা হলো যাদের দিয়ে, তারা এর আগে শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন না বেশির ভাগই।
মেধা মনীষার লালন, বিকাশের জন্য দরকার স্থিতিশীলতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফলে এতকাল ধরে চলে আসা গতিটা ব্যাহত হলো। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে আরও অনুকূল পরিবেশ, পাওয়া, উত্কর্ষ অর্জনের স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু সেটা আর পাওয়া হয়ে উঠল না। গবেষণার ক্ষেত্রে যে উত্কর্ষ ও ব্যাপ্তির প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি। গবেষণার ভুবনে ঈপ্সিত সাফল্য আমরা অর্জন করতে পারলাম না এখনও পর্যন্ত। সেই একটা শূন্যতা রয়েই গেছে। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ এই শূন্যতা পূরণ করতে সর্বশক্তি দিয়ে এগিয়ে এসেছে। তিন বছরব্যাপী একটা প্রকল্পের কাজ চলছে এখন। এই প্রকল্পের পুরো অংশই ঢাকা সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। এর আওতায় মোট ১৯টি বই প্রকাশ করা হবে। এর মধ্যে ১০-১২টি লেখা হয়ে গেছে এরই মধ্যে, বাকিগুলো প্রণয়নের কাজ চলছে। ঢাকার ঐতিহ্য, খাবার-দাবার, ভাষা, ফোকলোর, ইতিহাসসংক্রান্ত বই পুনর্মুদ্রণও এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সেমিনার এরই মধ্যে একটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আরও একটি শিগগিরই আয়োজন করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিষয়ক গবেষণা কেন পর্যাপ্তসংখ্যক হলো না? এর কারণ কী? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নানা কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকেনি। যারা যোগ্য পণ্ডিত, তাদের অনেকেই দেশে থাকেন না। থাকতে চান না। থাকবার অনুকূল পরিবেশেরও অভাব রয়েছে। গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যথেষ্ট ভালো করবার সুযোগ ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে শিক্ষাকে। সরকারের উচিত ছিল এই অরাজকতা, অবক্ষয় কঠোর হাতে দমন করা। এই দেখুন না আমাদের বাংলাপিডিয়া প্রকল্পে ১০ জন সিনিয়র প্রফেসর আগে সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। তাদের ধরে রাখতে পারিনি। উপযুক্ত সম্মানী দিতে পারছি না আমরা। এখন আগের চেয়ে তিন গুণ বেশি টাকা দিয়েও লোক পাচ্ছি না। বাংলাপিডিয়ার দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ চলছে এখন। তরুণদের মধ্যে উত্সাহী গবেষক আমরা খুঁজে খুঁজে বার করছি। আমাদের প্রয়াসে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। আমি সে কারণে হতাশ নই। তরুণদের মধ্যেও জ্ঞানচর্চার আগ্রহ ও কৌতূহল লক্ষ্য করছি। আমি আশাবাদী।
No comments:
Post a Comment