সরেজমিন
পদে পদে ভোগান্তি শ্রম আদালতে
ঢাকার শ্রম আদালতের আইনজীবীরা তাঁদের নির্ধারিত পোশাক এবং পরিচয়পত্র পরছেন না। ফলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, কে আইনজীবী আর কে নন। এ সুযোগে অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন। পেশকার, পিয়নদের বাড়তি খরচা আর কোর্ট ফির নাম করে দালালদের প্রতারণা হরহামেশাই দেখা যায়
১.
কাশেম মোল্লা (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যক্তি চাকরি করতেন একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে, গাড়িচালক হিসেবে। সাত মাস চাকরি করার পর স্থায়ী করা হয় এবং স্থায়ী করার দুই মাস পর তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় কোনো বেতন বা মজুরি পরিশোধ ছাড়া। ঢাকার শ্রম আদালতে কাশেম মামলা করেন বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য। ২০০৮ সালের শেষের দিকে তিনি শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী একটি ফৌজদারি মামলা এবং একটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন। দুই বছর পার হয়ে গেলেও মামলা দুটির কোনো সুরাহা হচ্ছে না। বরং শ্রম আদালতের পেশকার, পিয়নদের দ্বারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তিনি। নিজের আইনজীবীর ফি মেটাতে এবং পেশকার, পিয়নদের বাড়তি খরচাপাতি ঢালতে ঢালতে এ পর্যন্ত প্রচুর টাকা চলে গেছে চাকরিহীন কাশেমের। তাঁর অভিযোগ, একদিকে প্রতিপক্ষের বড় কোম্পানির ব্যারিস্টার সাহেবদের বারবার সময় নেওয়ার কারণে তাঁর মামলা দুটি ঝুলছে দুই বছর ধরে, অন্যদিকে প্রতি তারিখে পেশকার, পিয়নদের খরচাপাতি না দিলে মামলার নথি উঠতে চায় না বিচারকের টেবিলে।
২.
রুবিনা আক্তার (ছদ্মনাম) চাকরি করতেন একটি কারখানায়। তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হলে তিনিও মামলা করেন শ্রম আদালতে। প্রথমে তাঁর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দালাল ধরেন তিনি। দালাল উকিল ধরে দেওয়ার নামে চার হাজার টাকা নেন এবং কোর্ট ফির নামে আরও এক হাজার টাকা নেন। পরে কয়েক মাস ঘুরেও উকিলের দেখা মেলেনি তাঁর। সেই দালালকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে আদালতের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন, এ আদালতে মামলা করতে কোনো কোর্ট ফিই লাগে না।
৩.
একজন ভুয়া কর্মচারী দ্বারা একটি মিথ্যা মামলায় হেনস্থা হচ্ছে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানি। ওই কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ভিনদেশি। ব্যবসায়িক কাজে প্রায় সময়ই থাকতে হয় দেশের বাইরে। আদালতে মিথ্যা মামলাটির কারণে কর্মকর্তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দিনের পর দিন। প্রতিপক্ষ বারবার সময় নেওয়ার কারণে বিদেশি কর্মকর্তারা সময়মতো আদালতে হাজির হতে পারছেন না। সম্প্রতি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় সমন জারি করা হলে তিনি হাজির হন আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন চাইতে। এসে দেখেন, সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক ছুটিতে আছেন। পরে পেশকার, পিয়নদের অনেক অনুরোধ করে আবেদনটি অন্য একটি আদালতে (চার্জে থাকা) শুনানি করা হয়। কিন্তু আদালত সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক না আসা পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন। ওই কর্মকর্তা পড়েন সমস্যায়। বাইরে বেশির ভাগ সময় অবস্থান করায় নির্ধারিত তারিখে হাজির না হলে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে পারে। আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজির হওয়ায় আবেদনেরও শুনানি হয়নি।
৪.
ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত একটি কোম্পানির কর্মকর্তার জামিন আবেদনের নকল তুলতে ভোগান্তিতে পড়েন সংশ্লিষ্ট মামলাটির আইনজীবী। আদালতের কর্মচারীরা জানান, বিচারক জামিনের আদেশে সই করে যাননি এবং তিনি কয়েক দিনের ছুটিতে গেছেন। পরে বেশ কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে নকলের কপি সরবরাহ করে দেবেন বলে কর্মচারীরা জানান। পরে অতিপ্রয়োজনের কারনে এই টাকা দিতেই রাজি হন পক্ষ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ জামিনের আদেশ কপিতে বিচারকের সই ছিল। শুধু বড় কোম্পানি দেখে কিছু টুপাইস কামিয়ে নেওয়ার জন্য কর্মচারীরা এ নাটক সাজিয়েছেন।
ঢাকায় শ্রম আদালতের ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এ অনুপাতে নিষ্পত্তি কম। বিচারকসংকট, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ঘাটতির কারণে সাধারণ শ্রমিক ও বিচারপ্রার্থীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, আদালতের কক্ষগুলো জরাজীর্ণ এবং এত ক্ষুদ্র পরিসরে তৈরি করা যে আইনজীবীদের গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের জন্য নেই কোনো বসার জায়গা। আদালতের কক্ষগুলোর সঙ্গে টয়লেটের অবস্থান হওয়ায় দুর্গন্ধে দম ফেলাই দায়। নোংরা পরিবেশ এবং চেয়ার-টেবিলগুলোর অধিকাংশ ভাঙাচোরা। বিদ্যুৎ চলে গেলে নেই জেনারেটরের ব্যবস্থা।
দেখা গেছে, শ্রম আদালতের আইনজীবীরা তাঁদের নির্ধারিত পোশাক এবং পরিচয়পত্র পরছেন না। ফলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, কে আইনজীবী আর কে নন। এ সুযোগে অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন। পেশকার, পিয়নদের বাড়তি খরচা আর কোর্ট ফির নাম করে দালালদের প্রতারণা হরহামেশাই দেখা যায়।
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের প্রতিটি আদালতে নির্ধারিত পোশাক পরে আসা বাধ্যতামূলক থাকলেও শ্রম আদালতে বাধ্যবাধকতার রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। ফলে তাঁরা পোশাক বিধির বিষয়টি এড়িয়ে যান। ফলে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানিতে পড়ছেন বলে তাঁরাও মনে করেন।
ঢাকার শ্রম ভবনের পাঁচ ও ছয় তলায় শ্রম আদালতের অবস্থান। শ্রম ভবনের নিচে প্রতিনিয়তই দালাল চক্রের দেখা মেলে। শ্রম ভবনের নিচে গড়ে উঠেছে কিছু টাইপ রাইটারের দোকান। এখান থেকে বিভিন্ন আবেদন, ওকালতনামা, হাজিরা কাগজ বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। সাধারণ শ্রমিকদের পক্ষে নির্ধারিত খরচের বাইরে এসব ব্যয়ভার বহন করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। ফলে অনেকে শ্রম আদালতে প্রাথমিক মামলা দায়ের করলেও পরবর্তী প্রতিটি তারিখে মামলা পরিচালনা করতে উৎসাহিত হচ্ছেন না। ফলে মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও মামলাজট বেড়ে যাচ্ছে।
১.
কাশেম মোল্লা (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যক্তি চাকরি করতেন একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে, গাড়িচালক হিসেবে। সাত মাস চাকরি করার পর স্থায়ী করা হয় এবং স্থায়ী করার দুই মাস পর তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় কোনো বেতন বা মজুরি পরিশোধ ছাড়া। ঢাকার শ্রম আদালতে কাশেম মামলা করেন বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য। ২০০৮ সালের শেষের দিকে তিনি শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী একটি ফৌজদারি মামলা এবং একটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন। দুই বছর পার হয়ে গেলেও মামলা দুটির কোনো সুরাহা হচ্ছে না। বরং শ্রম আদালতের পেশকার, পিয়নদের দ্বারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তিনি। নিজের আইনজীবীর ফি মেটাতে এবং পেশকার, পিয়নদের বাড়তি খরচাপাতি ঢালতে ঢালতে এ পর্যন্ত প্রচুর টাকা চলে গেছে চাকরিহীন কাশেমের। তাঁর অভিযোগ, একদিকে প্রতিপক্ষের বড় কোম্পানির ব্যারিস্টার সাহেবদের বারবার সময় নেওয়ার কারণে তাঁর মামলা দুটি ঝুলছে দুই বছর ধরে, অন্যদিকে প্রতি তারিখে পেশকার, পিয়নদের খরচাপাতি না দিলে মামলার নথি উঠতে চায় না বিচারকের টেবিলে।
২.
রুবিনা আক্তার (ছদ্মনাম) চাকরি করতেন একটি কারখানায়। তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হলে তিনিও মামলা করেন শ্রম আদালতে। প্রথমে তাঁর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দালাল ধরেন তিনি। দালাল উকিল ধরে দেওয়ার নামে চার হাজার টাকা নেন এবং কোর্ট ফির নামে আরও এক হাজার টাকা নেন। পরে কয়েক মাস ঘুরেও উকিলের দেখা মেলেনি তাঁর। সেই দালালকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে আদালতের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন, এ আদালতে মামলা করতে কোনো কোর্ট ফিই লাগে না।
৩.
একজন ভুয়া কর্মচারী দ্বারা একটি মিথ্যা মামলায় হেনস্থা হচ্ছে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানি। ওই কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ভিনদেশি। ব্যবসায়িক কাজে প্রায় সময়ই থাকতে হয় দেশের বাইরে। আদালতে মিথ্যা মামলাটির কারণে কর্মকর্তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দিনের পর দিন। প্রতিপক্ষ বারবার সময় নেওয়ার কারণে বিদেশি কর্মকর্তারা সময়মতো আদালতে হাজির হতে পারছেন না। সম্প্রতি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় সমন জারি করা হলে তিনি হাজির হন আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন চাইতে। এসে দেখেন, সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক ছুটিতে আছেন। পরে পেশকার, পিয়নদের অনেক অনুরোধ করে আবেদনটি অন্য একটি আদালতে (চার্জে থাকা) শুনানি করা হয়। কিন্তু আদালত সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক না আসা পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন। ওই কর্মকর্তা পড়েন সমস্যায়। বাইরে বেশির ভাগ সময় অবস্থান করায় নির্ধারিত তারিখে হাজির না হলে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে পারে। আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজির হওয়ায় আবেদনেরও শুনানি হয়নি।
৪.
ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত একটি কোম্পানির কর্মকর্তার জামিন আবেদনের নকল তুলতে ভোগান্তিতে পড়েন সংশ্লিষ্ট মামলাটির আইনজীবী। আদালতের কর্মচারীরা জানান, বিচারক জামিনের আদেশে সই করে যাননি এবং তিনি কয়েক দিনের ছুটিতে গেছেন। পরে বেশ কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে নকলের কপি সরবরাহ করে দেবেন বলে কর্মচারীরা জানান। পরে অতিপ্রয়োজনের কারনে এই টাকা দিতেই রাজি হন পক্ষ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ জামিনের আদেশ কপিতে বিচারকের সই ছিল। শুধু বড় কোম্পানি দেখে কিছু টুপাইস কামিয়ে নেওয়ার জন্য কর্মচারীরা এ নাটক সাজিয়েছেন।
ঢাকায় শ্রম আদালতের ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এ অনুপাতে নিষ্পত্তি কম। বিচারকসংকট, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ঘাটতির কারণে সাধারণ শ্রমিক ও বিচারপ্রার্থীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, আদালতের কক্ষগুলো জরাজীর্ণ এবং এত ক্ষুদ্র পরিসরে তৈরি করা যে আইনজীবীদের গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের জন্য নেই কোনো বসার জায়গা। আদালতের কক্ষগুলোর সঙ্গে টয়লেটের অবস্থান হওয়ায় দুর্গন্ধে দম ফেলাই দায়। নোংরা পরিবেশ এবং চেয়ার-টেবিলগুলোর অধিকাংশ ভাঙাচোরা। বিদ্যুৎ চলে গেলে নেই জেনারেটরের ব্যবস্থা।
দেখা গেছে, শ্রম আদালতের আইনজীবীরা তাঁদের নির্ধারিত পোশাক এবং পরিচয়পত্র পরছেন না। ফলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, কে আইনজীবী আর কে নন। এ সুযোগে অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন। পেশকার, পিয়নদের বাড়তি খরচা আর কোর্ট ফির নাম করে দালালদের প্রতারণা হরহামেশাই দেখা যায়।
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের প্রতিটি আদালতে নির্ধারিত পোশাক পরে আসা বাধ্যতামূলক থাকলেও শ্রম আদালতে বাধ্যবাধকতার রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। ফলে তাঁরা পোশাক বিধির বিষয়টি এড়িয়ে যান। ফলে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানিতে পড়ছেন বলে তাঁরাও মনে করেন।
ঢাকার শ্রম ভবনের পাঁচ ও ছয় তলায় শ্রম আদালতের অবস্থান। শ্রম ভবনের নিচে প্রতিনিয়তই দালাল চক্রের দেখা মেলে। শ্রম ভবনের নিচে গড়ে উঠেছে কিছু টাইপ রাইটারের দোকান। এখান থেকে বিভিন্ন আবেদন, ওকালতনামা, হাজিরা কাগজ বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। সাধারণ শ্রমিকদের পক্ষে নির্ধারিত খরচের বাইরে এসব ব্যয়ভার বহন করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। ফলে অনেকে শ্রম আদালতে প্রাথমিক মামলা দায়ের করলেও পরবর্তী প্রতিটি তারিখে মামলা পরিচালনা করতে উৎসাহিত হচ্ছেন না। ফলে মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও মামলাজট বেড়ে যাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment