
উদ্ভিদবিদরা বলছেন, শিকড় বিস্তারে যতটা জায়গা থাকার কথা, ঢাকার গাছগুলো সেটুকু না পেয়ে মরে যাচ্ছে। এর ফলে দিন দিন গাছশূন্য হয়ে পড়ছে ঢাকা। তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন সুদীপ্ত সালাম, সাপ্তাহিক ২০০০
মহানগরের বাইরেও কমছে পুকুর
ঢাকা মহানগরের বাইরে সাভার, ধামরাই, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ ও দোহারেও কমছে পুকুরের সংখ্যা। ফলে এসব পুকুরে মাছের উৎপাদনও কমে এসেছে। আগে সরকারি পুকুর ছিল ১২৫টি, যার পরিমাণ ৭৫.৮২ হেক্টর এবং বেসরকারি ছিল ৬ হাজার ৭শ ১৩টি, যার আয়তন ৪৯৮৫ হেক্টর। ২০১০ সালের হিসাব অনুসারে খাস পুকুরের সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকলেও বেসরকারি পুকুরের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭শ ২৯টিতে। অর্থাৎ ১ হাজার ৯শ ৮৫টি পুকুর কমে গেছে। এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা জেলার পাঁচটি উপজেলার মানুষ পুকুর ভরাট করে বিল্ডিং তৈরি করছে। এছাড়া এ অঞ্চলের মানুষদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুকুর ভরাট করে বিক্রি করছে। ফলে পুকুরের সংখ্যা কমে আসছে।
অবশিষ্ট কিছু পুকুর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর নিয়ে কুসংস্কার ছিলÑ এখানে গোসল করতে গেলেই মারা পড়ে লোকজন। এই কুসংস্কারের ভিত্তিটা যে কতটা পাকাপোক্ত সেটা টের পাওয়া যায় কর্তৃপরে সতর্কবাণী দেখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পুকুর আর জহুরুল হক হলের পুকুরেও সাঁতরানো যায় অনায়াসে।
রমনা পার্কের পুকুরটি অসম্ভব রকম সুন্দর। চারদিকে স্নিগ্ধ সুন্দর প্রকৃতি। তার মাঝখানে টলটলে জলাধার। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। তাই এখানে এলে পুকুরে নামতে ইচ্ছা করবেই। চাইলে পুকুরে সাঁতার কাটতে পারেন। তবে ততণ, যতণ পাহারাওয়ালার চোখে না পড়ে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুকুরে পুণ্যার্থীরা স্নান সারতে আসেন নিয়মিত। পুণ্য লাভের আশায় না হোক, গরম থেকে বাঁচতে চাইলে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন আপনিও। কদমতলা-রাজারবাগের শ্রীশ্রীবরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরে রয়েছে গঙ্গাসাগর দিঘি। এই দিঘিটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বিশাল। দেখতে খুবই মনোরম। বহু লোক প্রতিদিন এখানে আসে গোসল সারতে। সবুজবাগের ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারের পুকুরও উন্মুক্ত রয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। এখানে চাইলে যে কেউ এসে সকাল-সন্ধ্যা সাঁতার কাটতে পারবে। পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী-ইসলামপুরের নবাববাড়ির পুকুরে নামতে হলে অবশ্য কিছু টাকা খরচ করতে হবে। মাত্র তিন টাকাতেই মেলে এখানে গোসল করার অনুমতি। তবে এই পুকুরে গোসলের সময় কোনও ধরনের সাবান ব্যবহার করা যায় না।
পুরান ঢাকার বংশাল পুকুরে রয়েছে সিঁড়িসহ দুটি ঘাট। বংশালের পুকুরটি ছয় বিঘা জমির ওপর কাটা। ১৮৪০ সালের আগে এলাকাবাসীর পানি সমস্যা সমাধানের জন্য বংশালের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও জমিদার হাজি বদরুদ্দীন ভুট্টো নিজ জমিতে খনন করেন এ পুকুর। এ কারণে পুকুরটি ভুট্টো হাজির পুকুর হিসাবেও পরিচিত। প্রায় ৪শ ফুট লম্বা ও ২শ ৫০ ফুট চওড়া এ পুকুরটির গভীরতা ৩০ থেকে ৪০ ফুট। পুকুরটির চারদিকে পাকা বেষ্টনী ও রাস্তা। রাস্তার পাশ ধরে পুকুরের চারদিকে সারিবদ্ধভাবে লাগানো আছে নারকেল গাছসহ অন্যান্য গাছ। টলটলে স্বচ্ছ পানিতে এসব গাছের ছায়া সৃষ্টি করে নৈসর্গিক সৌন্দর্য। পুকুরটির চারদিকেই লোহার গ্রিল দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী, যাতে কোনও শিশু পানিতে না পড়ে যায়। পুকুরটির উত্তর ও দণি পাশে রয়েছে দুটি শান বাঁধানো ঘাট। ঘাট দুটির প্রবেশপথে আছে লোহার গেট আর ওপরে ছাউনি। উত্তর পাশের ঘাটটি ব্যবহার করেন বংশালে বসবাসরত ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দারা, আর দণি পাশের ঘাটটি বাইরের লোকের জন্য। এজন্য এ পাশের ঘাটে বসানো হয়েছে টোল ব্যবস্থা। প্রতিবার গোসলের জন্য প্রত্যেককে দিতে হয় দুটাকা। দণি ঘাটের পাশেই পুকুরের পানিতে বসানো হয়েছে পানির পাম্প। তার ওপরে পাকা পাটাতনের ওপর আছে পানির ট্যাঙ্ক। পাম্পে তোলা এ পানি এলাকাবাসী ব্যবহার করছে খাবার ও রান্নাবান্নার কাজে।
পুকুরটি নিয়ে ভুট্টো হাজিরই বংশধর ও ঘাটের টোল আদায়কারী মোজাফফর হোসেন বলেন, এই দণি ঘাটেই প্রতিদিন ১ হাজার ২শ থেকে ১ হাজার ৫শ লোক গোসল করে। সে হিসাবে দুঘাটে প্রতিদিন প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার লোক গোসল করছে। তিনি আরও বলেন, পুরান ঢাকাসহ এ নগরীতেই এক সময় আরও অনেক বড় পুকুর বা দিঘি ছিল, বর্তমানে সেগুলোর কোনও অস্তিত্ব নেই, বিলীন হয়ে গেছে রণাবেণের অভাবে।
নওয়াব আবদুল বারীর পুকুর
আহসান মঞ্জিল পরিবারের নওয়াব আবদুল বারীর খননকৃত বিশাল পুকুর। সময়টা ১৮৩৮ সাল। প্রায় ১৭১ বছরের পুরনো ইতিহাস। আর অনেক উত্থান-পতনের সাী এই গোল তালাব বা গোল পুকুর। বড় বড় বিল্ডিংয়ের ঘেরাটোপে একখ- কোমল স্নিগ্ধতা এই পুকুর। অনেক চড়াই-উত্তরাই পেরিয়ে আজ এই পুকুর পরিচালিত হচ্ছে মৌলভি খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে। এই ট্রাস্ট পরিচালিত হচ্ছে নওয়াব পরিবারেরই বংশধর, স্থানীয় মুরব্বিদের দ্বারা। এখানে গোসলের ব্যবস্থা আছে কিন্তু কাপড় কাঁচা, সাবান ব্যবহার করা নিষেধ। মৌলভি খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই প্রতিবছর এই পুকুর পাড় ঘিরে আয়োজিত হয় মীনা বাজার, মেলা, মাছ ধরা প্রতিযোগিতা। আর প্রতিদিন বিকালের আড্ডা তো আছেই।
৪টি খাল নিশ্চিহ্ন, ১৩টি থেকেও নেই
ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার মূল কারণ অবৈধভাবে খাল দখল ও ভরাট করা। স্বাধীনতার আগে এ শহরে ৪৭টি খাল ছিল। বেশিরভাগ খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটের বেশি। খালপথে নগরের পানি নিষ্কাশিত হতো। স্বাধীনতার পর মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে ঢাকা মহানগর এলাকার ২৫টি খাল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২২টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও সেগুলো ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত খাল ছিল, ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে এর নাম পরীবাগ খাল। তবে সেখানে এখন খালের কোনও চিহ্ন নেই, খালটি এখন সোনারগাঁও সড়ক। পরীবাগ খালের মতোই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঢাকার অবশিষ্ট খালগুলো। রাজধানীর পানি খালগুলো দিয়েই বুড়িগঙ্গাসহ আশপাশের নদীতে গিয়ে পড়ছে। খালগুলো বেদখল হওয়ায় পানি আটকে প্রতিবছরই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা, যা দুর্ভোগে ফেলে নগরবাসীকে। বর্তমানে পরীবাগ, রায়েরবাজার, আরামবাগ ও গোপীবাগ এ চারটি খালের কোনও অস্তিত্বই নেই।
প্রায় এক যুগ আগে শাহবাগ থেকে উৎপত্তি হয়ে বড় মগবাজার পর্যন্ত পরীবাগ খাল, কাটাসুর খাল হতে উৎপত্তি হয়ে সরাইজাফরাবাদ ও সুলতানগঞ্জ মৌজার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রায়েরবাজারের বেড়িবাঁধ পর্যন্ত রায়েরবাজার খাল, বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত আরামবাগ খাল এবং গোপীবাগ থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে আরামবাগ খাল পর্যন্ত গোপীবাগ খাল ছিল। নগর কর্তৃপরে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সময়ের ব্যবধানে খালগুলো সড়কে পরিণত হয়েছে।
রাজাবাজার খাল, ধোলাইখাল-১, ধোলাইখাল-২, শাহজাহানপুর খাল, গুলশান-বনানী খাল, ধানমন্ডি খাল, দণিগাঁও-নন্দীপাড়া খাল, রাজারবাগ-নন্দীপাড়া খাল, নাসিরাবাদ-নন্দীপাড়া খাল, নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খাল, ডুমনি খাল, বাউখার খাল এবং গোবিন্দপুর খালÑ এ ১৩টি খাল থেকেও নেই! এর মধ্যে রাজাবাজার খাল (রাজাবাজার পশ্চিম পাশ থেকে হোটেল সুন্দরবন পর্যন্ত), ধোলাইখাল-১ (দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু থেকে ধোলাইখাল-২ পর্যন্ত), ধোলাইখাল-২ (বুড়িগঙ্গা নদী থেকে সূত্রাপুর, গে-ারিয়া, দয়াগঞ্জ, ওয়ারী শহর ঢাকা মৌজা (পুরান) হয়ে দয়াগঞ্জ বাজার পর্যন্ত, ধানমন্ডি খাল, নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খালে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
ঠিকমতো দেখভাল না হওয়ায় বাকি খাল সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরের খালগুলো ধ্বংসের একটি বড় কারণ ঋণপ্রদানকারী গোষ্ঠী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পরিবেশ বিষয়ে উদাসীনতা। সরু বক্স কালভার্ট, সড়ক ও ভবন নির্মাণসহ বিভিন্নভাবে বন্ধ করা হয়েছে খাল। এসব কার্যক্রমে সক্রিয় সহযোগিতা বা আর্থিক জোগান দিয়েছে ঋণপ্রদানকারী গোষ্ঠী। উন্নয়নের নামে খাল ভরাট করে নর্দমায় রূপান্তর কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিবেশ আইন ১৯৯৫, পরিবেশ নীতিমালা, বেঙ্গল ক্যানেল অ্যাক্ট ১৮৬৪ ও জলাধার সংরণ আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে। জলাশয়বিহীন রাজধানী জনজীবনের জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। দেখা দেবে ভূমিকম্প, জীববৈচিত্র্য হবে তিগ্রস্ত। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশসঙ্কটের আশঙ্কা করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা যা শুধু পরিবেশ নয়, অর্থনীতির জন্যও নেতিবাচক পরিণতি ডেকে আনবে।
| তারিখ: ১৬-০১-২০১১