Pages

Search This Blog

Friday, March 25, 2011

ঢাকাই হাতি : মোগলদের একটি বড় বিনোদন ছিল হাতির লড়াই


ঢাকাই হাতিমোগলদের একটি বড় বিনোদন ছিল হাতির লড়াই রফিকুল ইসলাম রফিক পৃথিবীর নানা দেশেই হাতি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহন হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানেও হাতির উপস্থিতি আমাদের চোখে পড়ে। বিশাল আকৃতির এ প্রাণীটি বেশ শান্ত মেজাজের। আর স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে হাতিই সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী। একসময় মানুষ একে দিয়ে করিয়েছে শ্রমসাধ্য সব কাজ। তারপর আজকের এ যন্ত্র-সভ্যতার কালে ভারী ভারী সব যন্ত্র আসায় হাতির ব্যবহার অনেকটা কমেছে। সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে মির্জা নাথানের লেখা 'বাহারস্তান-ই-গায়ব' নামের বইয়েও মোগলদের হাতির লড়াই এবং বিভিন্ন কলাকৌশল প্রদর্শনের বিবরণ আছে। ঢাকার বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও হতো হাতির প্রদর্শনী। চার্লস ডয়লির আঁকা চিত্রগুলোতেও চোখে পড়ে এ প্রাণীটি।
হাতির লড়াই মোগল বাদশাহ ও সুবেদাররা খুব পছন্দ করতেন। ঢাকা শহরে একসময় যখন-তখন হাতির ডাক কানে আসত। হাতির খেদার জন্য ঢাকা ছিল বিখ্যাত। কম্পানি আমলে যে স্থানে বন্য হাতি পোষ মানানো হতো, সে স্থানকে বলা হতো পিলখানা। ফারসি পিল শব্দটির অর্থ হাতি আর খানা অর্থ জায়গা। দুটো মিলে পিলখানা। যার বাংলা অর্থর্ হাতিশালা। এখানে টাকার বিনিময়ে হাতি পোষ মানানো হতো। মোগল যুগে শহরের উত্তরাংশে বেশ বড় একটা পিলখানা গড়ে উঠেছিল। যে এলাকাটিতে মাহুতরা বসবাস করতেন, সে স্থানটি আজও মাহুতটুলী নামে পরিচিত। আজকের ঢাকায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের সদর দপ্তরের পশ্চিম দিকে যে বড় মাঠ ছিল, সেটাকে বলা হতো পিলখানা বা হাতির খেদা। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির আমলে পিলখানা বিরাট এলাকা নিয়ে স্থাপিত হয়। সরকারি হাতি সে সময় এখানে রাখা হতো। ঢাকার জমিদাররা ভাড়া দিয়ে হাতি রাখতেন এখানেই। হৃদয়নাথ তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, '১৮৬৪ সালে যখন আমি ঢাকায় আসি তখন খেদার কাজ চলছিল পুরোদমে। আসাম থেকে প্রতিবছর হাতি ধরে নিয়ে আসা হতো এখানে এবং যত দিন না ব্যবহারের উপযুক্ত হতো, তত দিন সেগুলো রাখা হতো সেখানে। জমিদাররা সামান্য অর্থের বিনিময়ে সরকারি খেদায় হাতি রাখতে পারতেন। প্রথম যখন আমি পিলখানা দেখতে গিয়েছিলাম, তখন সেখানে ছিল দেড় শ হাতি। পিলখানা সরাসরি ছিল ভারত সরকারের অধীনে। আঞ্চলিক কোনো সংস্থা পিলখানায় কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারত না। ঢাকেশ্বরীর জঙ্গল ব্যবহৃত হতো এসব হাতি চরানোর জন্য। চার্লস এলিয়েট যখন বাংলার গভর্নর সে সময় ১৮৯৫ সালে একবার হাতির খেদার চমৎকার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। একসময় বিরাট পুকুরের মতো ডিচ ছিল ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দক্ষিণ পাশে। নবাবদের হাতিগুলোকে সেখানে গোসল করানো হতো। এ ছাড়া হাতির খাবারের গুদামঘর নির্মাণ করা হয়েছিল ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পশ্চিম পাশে। লালবাগের আমলীগোলা এলাকায় হাতির দাঁত দিয়ে নানা রকম শৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করা হতো। আর হাতির দাঁতের চিরুনি তো সারা পৃথিবীতেই বিখ্যাত। ঢাকায় তৈরি হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম তখন বিদেশেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। পিলখানার হাতিগুলোকে চারণভূমিতে নেওয়ার জন্য যে রাস্তাটি তখন ব্যবহার করা হতো, সে সড়কটি এখন এলিফ্যান্ট রোড নামে পরিচিত। এলিফ্যান্ট রোডের এ স্থানটিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পুল ছিল এবং পুলটি হাতিরপুল নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিল। পুলটি অনেক উঁচু হওয়ায় এর নিচ দিয়ে স্বচ্ছন্দে হাতি চলাচল করত। হাতিরপুল নাম অনুসারে সেখানে এখন একটি কাঁচাবাজারও আছে। এ রাস্তা সোনারগাঁ ও পরীবাগ সড়ককে সংযুক্ত করেছে।
ঢাকার ঈদ মিছিলেও হাতির শোভাযাত্রা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত। নানা রকম জরি আর মখমল কাপড় দিয়ে সাজানো হতো একে। সঙ্গে নবাবদের সুসজ্জিত বাদ্যযন্ত্রীর দল নানা রকম বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তার পেছন পেছন চলত। শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষে ভাদ্র মাসে ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হতো। এক পাল হাতিও ছিল সে মিছিলের বড় আকর্ষণ। ঢাকার পিলখানার হাতি সুন্দর সাজে সাজিয়ে প্রধান প্রধান রাজপথের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। মহররম মিছিল এখনো হয়, অবশ্য জৌলুস আগের মতো নেই। অতীতে এ মিছিলে থাকত নিশান সজ্জিত হাতির দল। আজো ঢাকার বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে কদাচিৎ হাতির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

মির্জা নাথানের লেখা 'বাহারস্তান-ই-গায়ব' নামের বইয়েও মোগলদের হাতির লড়াই এবং বিভিন্ন কলাকৌশল প্রদর্শনের বিবরণ আছে। ঢাকার বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও হতো হাতির প্রদর্শনী। চার্লস ডয়লির আঁকা চিত্রগুলোতেও চোখে পড়ে এ প্রাণীটি।

No comments:

Post a Comment